কবিতাঃ বিষাদ - "সেইসব মজা দীঘি"
১৭- ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ বাংলালাইভের i-পত্রিকায় প্রকাশিত। (i-পত্রিকা আর্কাইভ এখন আর পাওয়া যায় না)
=======================================
পাঠপ্রবেশক হিসেবে এটাও থাকল।
![]()
দেখে এলাম কিংকং, সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে ন'টা। এমন নয় যে আমি জানিনা গল্পোটা, কিন্তু টাইমস অফ ইণ্ডিয়া দেখি সাড়ে চার খানা স্টার মেরেছে রেটিং এ, তাইলে তো দেখতেই হয়। তা দেখলাম বটে একখান সিনিমা, ২৫ ফুট গেরিলা, সাথে বিকুষ্টি কালো আদিবাসী সম্প্রদায় আর ডাইনোসর ফ্রী।
শুনে হিংসে করবেন না, একটা জোঁক একটা লোককে মাথার দিক থেকে স্রেফ গিলে খেয়ে নিল। বড়ে পোকা মারতে মেশিনগান চলছে ট্রা রারারারা গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে পাহাড়ী উইপোকা, বাজপাখির মতো মশা, আর নায়িকা ..... এমনকি গোরিলাকেও ভালোবেসে ফ্যালে আর গোরিলাটা ..... সত্যি ভালোবাসাই যায় অবিশ্যি ....... কি অভিমানই না করল, চোখে জল আসে আহা !!
শহরের সবথেকে উঁচু ফ্ল্যাটবাড়িটার সবথেকে উঁচু ছাদে চড়ে আত্মহত্যা করল। তারপর টাইটানিকের নায়কের মতো জাস্ট পড়ে গেল, বাতাস কাটতে কাটতে হুস্স্স্স্স্স্স পড়তে থাকা তার কালো দেহ, ইস্স চোখের কোল এখনো ভিজে !!
যখন নায়িকার দিক থেকে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে সূর্যাস্তের সামনে এসে বসছে, আর নায়িকা ভেবেছে বুঝি সার্কাস দেখাই নি বলে অভিমান করেছে, পাথর
তুলে লোফালুফি রত নায়িকার দিকে সেই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি, আর সামনের অপার্থিব সূর্যাস্তের দিকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া - আহা দেখা যায় না!! আমার রুমাল পুরো ভিজে গেছিল হল থেকে বেড়োবার আগে। মাঝে তো মনেই হচ্ছিল, ধুস্, ন্যাকা নায়কটা চুলোয় যাক, আমি স্ক্রীপ্ট লিখলে নায়িকাকে কঙের সঙ্গেই সেই জঙ্গুলে দ্বীপে পাঠিয়ে দিতুম।
আর, সে কি ডাইরেক্টর!! সে কি কনফি!! পাঁচ পাতার স্ক্রীপ্ট, শুধু শুরুটুকু, ভাঙা ক্যামেরা, দুজন অ্যাক্টর, একজন সাউণ্ড রেকর্ডিস্ট, একজন সহকারী, পিছনে ঝুলছে ওয়ারেন্ট, সিঙ্গাপুরের নাম করে পাড়ি দিল অজানা দ্বীপে শ্যুটিং করতে। ভাবুন, দেখতে পাচ্ছেন বিশাল মাকড়শা, দৈত্যের মতো আরশুলা, আর টিরানোসরাস রেক্সের সাথে কিং কং এর মারামারি !! তোফা তোফা। পালে পালে ডাইনোসর দৌড়চ্ছে আর পায়ে পায়ে পিষে যাচ্ছে টিরানোসরাস জাহাজের মাল্লা সিনেমার সহকারী -কি শিহরণ!! উ: !! ওরে পাগোল , একবার দেখে আয়,
শতাব্দীপ্রাচীণ আদিবাসীরা কাঠের খাম্বা পিটিয়ে জঙ্গল জাগিয়ে দ্রিম দ্রিম বাজনায় গলায় হাড়ের মালা পরিয়ে দুর্বোধ্য মন্ত্রে নায়িকাকে পুলিচালিত সেতুর থ্রু-তে পঠিয়ে দিল কিং কং এর কাছে, পায়ের নীচে দিয়ে জাস্ট বয়ে যাচ্ছে আগুনের নদী - আর জাহাজ থেকে অপহৃত নায়িকা দুহাত টান করে উপুরে বাঁধা - নিষ্পাপ বগল - অকস্মাৎ চেয়ে দেখল সেই ২৫ ফুট কালোরোমশ - তুলনা হয়??
দেওয়াল বললে বুঝতে পারবে না অমন রাক্ষসপুরী, জঙ্গল বললে বুঝবে না অমন মাকড়শার জাল, গাছের ঝুরি, লতাল্মের দড়ি-দড়ায় দোল খেতে খেতে
ঝুলন্ত নায়িকা ঝুলন্ত টিরানোসরাসের মুখের কাছে একবার আসছে, আর কামড়গুলোকে হাওয়ায় অসমাপ্ত রেখে দোল খেয়ে সরে যাচ্ছে!! পাগোল পাগোল!! উফ্ !! আর ইয়া লম্বা বাঁশে দোল খেয়ে পোলভল্টের যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে পাহাড় থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়া সে পিশাচবৎ আদিবাসীরা!! চোখ ওল্টানো, চুলে ঢাকা মুখ, চোয়ালের নীচে দাঁত - যেন দানবপুরীর দু:স্বপ্ন!!
দিনে স্রেফ একবার শো-এর সময়ে নায়িকাকে দেখতে পাবে এই আশায় ভর করে কিংকং হাতের স্টেনলেসস্টীলের হাতকড়াকেও পাত্তা না দিয়ে পাবলিক স্টেজে এসে দাঁড়ায়, বন্দী, আর নায়িকার বদলে তার সামনে তুলে দেওয়া হয় অন্য একটি মেয়ে!! চোখের দৃষ্টির সেই পাল্টে যাওয়া, নাকে ক্লোরোফর্মের বোতল ভাঙার স্মৃতি চুরমার করা সেই গর্জন!! আহত প্রেমিকের জন্যে থাক দু ফোঁটা চোখের জল।
আমি মুগ্ধ, আমি মুগ্ধ, যখন রাজপথে পড়ে থাকা কিংকং এর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত পুলুশবাহিনীর সামনে এসে ডাইরেক্টর বলে যায়, হেলিকপ্টার নয়, দানবকে খুন করেছে আসলে রূপ -নারী এক - মোচড় দিয়ে ওঠে বুকে মাইরি বলছি। ভেবে দ্যাখো আক্রমণোদ্যত গর্জমান জঙ্গী বোমারু বিমানের সামনে শহরের উচ্চতম প্রাসাদচূড়ায় উঠে আড়ালহীন হয়ে যায় সে স্বেচ্ছায়, আর বুকে চাপড় মেরে বন্য চিৎকারে হাত বাড়িয়ে ধরে নেয় প্রায় মেগ-২৪, তুলে আছাড় মারে শূন্যেই ভাবা যায়!! ডানা ছিঁড়েই নিল সে বিমানের - যেন ফড়িং!!
আহা সেকি অনুভূতি, অসাধারণ! আমি বহুদিন মনে রাখব সেই পশুপাখির খাঁচায় বসে চিত্রনাট্যের স্ক্রীপ্ট লেখা নায়ককে - কি ডেডিকেশন - পেন চুরি করে নিয়ে যায় চা দিতে আসা ছুটকো বালক, সে জানতেই পারে না - টাইপরাইটার বেজে চলেছে কি ব্যঞ্জনায় খট খট- স্কাল আইল্যাণ্ড। এখেনে বলে লাভ নাই, এতো গভীর অনুভূতির দাম কি সবাই দিতে পারে? যখন কিংকং এর মুঠোয় ভেসে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও লি ছোড়ে ক্যাপ্টেন আর তার আগে সেই অনাথ ছুটকো ছেলেটাকে বলে জাহাজে ফিরে যেতে - তুলনা পাবে শহুরে সভ্যতায় ??
না:, আর লিখবো না, লিখে কি বোঝাতে পারব সেই অনুভূতি - শহরের ছাদে বসে নায়িকাকে অস্তসূর্যের দিকে দেখিয়ে কিংকং কিভাবে বাঁ হাত মুঠো করে বুকে রাখে, যেমন নায়িকা রেখেছিল, জঙ্গলের পাহাড়ি চূড়া থেকে দেখে শেষ সূর্যাস্ত, কিং কং এর হাতের পাতায় নিশ্চিন্তে
ঘুমিয়ে পড়ার আগে? চোখ, শব্দহীন পটচোখে গড়ে উঠতে থাকা ভাষা - আলতো অভিমান, ছোট্ট মানবীটিকে নিয়ে খেলা, আর সেই অলীক সার্কাস ম্লান মিশে যেতে থাকে সেই গোধূলীবেলায় - আমদের কবিরাই তো বলেছেন, কনে দেখা আলো!!
এ অলীক মায়াখেলায়ও যদি মনে রাখি বাক্য ও বিন্যাসের টেকস্ট, ধিক্কার, আমি তবে কিছুই দেখিনি, কিভাবে অর্থ সমৃদ্ধির শিখর ছেড়ে দেয় মেয়েটা শুধু দৈত্যাকার প্রেমীটিকে ধোঁকা দেবে না বলে, নামহীন, আলোহীন ব্যালেড্যান্সের গ্রুপে যোগ দেয় আর তার সামনে দিয়ে উড়ে যায় ছেঁড়া পোস্টার, শহরময় সামরিক দাপাদাপির মধ্যে, কিং কং বেরিয়ে এসেছে শিকল ছিঁড়ে - সে দেখেছে তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দীকে সেই স্ক্রীপ্ট রাইটার। কিভাবে সিনেমার প্রোডিউসার, ডাইরেক্টরকে মুখের ওপোর বলে সিনেমা যে করছো তাতে খোলামেলা মেয়েরা থাকছে তো, আর ডাইরেক্টর রীল উঠিয়ে নিয়ে চলে আসে সেই অজানা জঙ্গলে যেখানে কিংকং স্রেফ দুটো চোয়াল ফাঁক করে খতম করে দেয় টিরানোসরাস রেক্স, আর শেষ বার নাড়িয়ে দেখে নিতে থাকে দুটো দুলন্ত চোয়াল - আমার নায়িকাকে খেতে এসেছিস হতভাগা!!
যদি বৈষ্ণব পদাবলী না পড়ে থাকো তো দেখোনা, কিভাবে বুঝবে সেই ব্যথা - অদেখা ভালোবাসার প্রথমবার মুখোমুখি হতে এসে নায়িকা কিভাবে আয়নায় প্র্যাকটিস করে বারবার, আর ভুল লোককে ধরে বলে যেতে যেতে থাকে - আমি আপনার লেখার পোচোন্ডো ফ্যান, এ সি, এয়ার কুলার, কিন্তু আপনাকে একেবারেই আপনার ছবির মতো দেখতে লাগে না, আর কি অদ্ভুত লেখেন আপনি? (ব্র্যাকেটে - ""আমাকে নাও"")। এভাবে হয় না, পোস্তোর গন্ধ নাকে নিয়ে কি আমি বলে যেতে পারবো, কিভাবে স্ক্রিপ্ট রাইটার নিজের লেখা কমেডি নাটকে ঢুকিয়ে দেয় তার চোখের জল - নায়িকার মুখে - আমাদের ব্যপারটা হয়ত কোনো পরিণতির দিকে যাচ্ছিল - কিন্তু সেও আর কিছু বলল না, অনেক অপেক্ষা করলাম আমি, তবুও সে আর কিছুই বলল না!! আহা, কলজে চিরে রক্ত বেরিয়ে আসে !!
আলুপোস্তো!! সেই স্বর্গীয় স্বাদ জিভের অনুভুতি বেয়ে চোখে নেমে আসবে, যখন দেখবে জাহাজের ডেকে অভিনয় করতে করতে অবশ, অসাড় হয়ে যাচ্ছে নায়িকা, নায়ক স্ক্রীপ্ট রাইটার তাকিয়ে আছে তার দিকে আর ডাইরেক্টর বলল, রু অন্যদিকে যাও, আমাদের একটু শ্যুটিং করতে দাও, ঠিক চোখে পাবে সেই স্বাদ, সেই বিমোহী স্বাদ। বিদায় জনতা। বিদায়, এই মহান ট্র্যাজেডির কথা আমি মাইকে মাইকে প্রচার করে যাবো, পৃথিবীর শেষ সমালোচনার সন্ধ্যে পর্যন্ত, তাপ্পর, দুগ্লাস টেকিলা গিলে চোখের জল মুছে ঘুমিয়ে পড়ব।
এ দেশের মায়ের নাম নদী, বাপের নাম গদি। যুগে যুগে চারণ কবি গান গেয়েছেন - "রাম তেরি গঙ্গা ময়লী হো গয়ি-ই-ই-ই-"" আর তাতে রামের বয়ে গেছে। তিনি কি আর গঙ্গার জলে কুলকুচি করতে যাবেন? "বাঙালী লেখক" সন্দীপন লিখেছিলেন দেশের সত্তর ভাগ লোক যে জল পান করে তাতে ওদের অন্তত: একবার ছোঁচাতে রাজি হওয়া উচিত - বা, এই রকম কিছু। ""বা-লে""র কথায় কান দিতে হলে অবশ্য মাথার দুদিকে দুটো কান থাকা আশু প্রয়োজন, আর কে না জানে গদিতে বসার প্রাথমিক শর্ত ও-দুটোকে প্রবেশদ্বারের বাইরে রেখে আসা? কিন্তু মাইরি, বেঁচে থাকা ক্যান্টার করে দিল গ্লোবালাইজেশন আর তার মাসতুতো ভাই প্রাইভেটাইজেশন। রামরাজত্বের টিউবলাইট ডুম করে কেরোসিন বিধৌত রাজপাটে গালভরা মাছি মুখে গদিয়ান গোদা সাক্ষীগোপাল রামের নাকের ডগাতেই খাল বিল নর্দমার গঙ্গাজলে বোতল ভরে কোক-পেপসী লাট হয়ে বসল। লে:। এক্ষণে গঙ্গার ময়লা জলের দিকে তাকাতে হয় বৈকি। নতুবা বেবাক লোক গণকলেরায় চটকে গেলে গদি কি আর স্পঞ্জ ফুঁড়ে উঠে নিতম্বে স্প্রিং ফোঁটাতে ছেড়ে দেবে? তো, মাঝে মাঝে চেগে উঠতে হয়। ক্যামেরা সহযোগে দেখাতে হয়, পেচ্ছাপ করতে দাঁড়িয়ে, এই দ্যাখো, পৈতে আমি নিয়ম মেনে কানে জড়িয়েছি। স্প্রাইটের বোতলে পোকামাকড়ের শহীদ দেহ, পেপসির বোতলে বীর্যমাখা, সরি, ব্যবহৃত কণ্ডোম, এবং অবশ্যই গত মরশুমে নিয়ম মেনে আরো একবার কীটনাশকপত্র পাওয়া গেছিল। (গদিয়াল রুলিংপার্টিগুলির নাম ক্রমান্বয়ে স্মরণ রাখবেন,) এবারেও গেছে। সহ্যসীমার তিরিশ গুন।
ইদিকে পাবলিক রেসপন্স কিন্তু মেগাস্টারের ল্যাজস্পর্শে ধন্য। ই: ! গভমেন্টের আঁতলামো দেখলে হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ""ওরে! বাইরে গিয়ে দেখে আয়, সূর্য উঠেছে!!"" আমাগো দ্যাশে জলে ও দুধে টোটাল কীটনাশক কাউন্ট করে দ্যাখো চাঁদ হেলথ স্ট্যাণ্ডার্ডের চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে। শুধু কুষ্ঠরুগী কেন, হাইড্র্যান্ট ফাঁসুক না ফাঁসুক, নর্দমার জল দুবেলা ঢকঢকানো লোকেদেরকে টিউকল টিপে ফ্রেশ জল দেখালে - এ নির্ঘাৎ ঈশ্বরের পানীয় - বলে দমাশ ফিটপ্রাপ্তি অসম্ভব নয়। এমত বাক্যে এক্সক্ল্যামেশন প্রত্যাশী অবিশ্বাসীদের জন্যে ঝামা বাগিয়ে রেখেছে আরবসাগরের উপকূলবাসী মুম্বাই ও গুজরাতসন্তানেরা। সমুদ্রের জলের নোনতামো গেছে কি হাড়ি কলসী বালতি ও বোতল হাতে দে লাফ। সে জলে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরীর বর্জ্যই থাক কি ফ্লুরাইড, চাই কি গুচ্ছ কীটনাশকই বা থাকল, বা ফেলে দেওয়া কোকাকোলার স্টক। তো? ভগমান নিজ হাতে বন্যা দিয়ে শহরভরের হাইড্রেন আর সেপটিক ট্যাঙ্ক ধুয়ে লবণ কাউন্ট কমিয়ে দিলেন, চমৎকারের এমন হুলাহুলা সেই গনেশের ঢুকুঢুকুর আগে আর শোনার নজির আছে? সে সব হত সত্য যুগে। এদের জন্যে কিনা সফট ড্রিংকস ব্যান! খেজুর আর কারে কয়? কিং খানের সোজা কথা, এখানে ব্যান করলে আম্রিকায় গিয়ে খেয়ে আসব, হ্যাঁ।
গদির জন্যেই শুধু, আহা, মমতা হয়। (যদিও মমতার জন্যে গদি নয়।) রামে লক্ষ্মণে তো পেপসি কোকের কলার হাঁকড়ে মানিব্যাগ ছিবড়ে করেই খালাস। অত:পর ভরত শত্রুঘ্নের জন্যেও দু-এক পীস সফটড্রিংকসওয়ালা মার্কেটে পড়ে থাকবে তো? নইলে আবার কবে কোন আকাট গাম্বাট বেমক্কা সেই "গঙ্গা ময়লী" গান গেয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের পানীয় জল সংস্কার ও তার স্বাস্থ্যবিধিসম্� �ত সার্বিক সরবরাহের আবদার আন্দোলন ফেঁদে ফেললে তখন সে ম্যাঁও সামলাতে ক্ষুদি হবে কোন মেগাস্টার?
বাসে উঠলেও শোনা যাবে "পিছন দিকে এগিয়ে যান'। ফ্লুরোসেন্ট হাইলাইট : "এগিয়ে'। সমকালে যে শব্দটিতে, অনিচ্ছাতেও, "অগ্রগতি' আর "উন্নয়ন'-এর দিকে অবধার্য আঁকশিটান। আমরা কিন্তু আরো স্পেসিফিকালি, ফোকাস করব অন্য একটি রিলেটেড অংশশব্দ : "গতি' তে। যে গতি, পথ ফুরোবার পরেও জেগে থাকে, অনবধান অভ্যাসে। নিউটন "জাড্য' নাম দেন।=====================
"গতি' টানলেই "বেগ' আসবে - "জোরে' না "আস্তে', সুতরাং কম্প্যারিজন, আর আমরা এসে দাঁড়ালাম সভ্যতার ষষ্ঠ রিপুর সামনে। রেস ও র্যালিময় আমাদের মুহুর্তিক বেঁচে থাকা, সুযোগ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে তুলনাবিম্বনে দেখে সুখসমীক্ষা, প্রকৃত প্রস্তাবে, অগণন প্রতিদ্বন্দ্বী জন্ম দিয়ে চলে শুধু। কি মজার! গর্ভযন্ত্রণাহীন এই প্রসববাহুল্যে ক্লান্তি নেই, বিচলন নেই, আদতে কুত্রাপি সেই বোধটাই নেই!
নতুন রাস্তাঘাট হচ্ছে। যানজট কম। নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা অপরিণত। হাতে স্টিয়ারিং। এসো গতি, এসো গতি, ঊর্ধ্বশ্বাসে এসো। রাজারহাট - সল্টলেক আই টি পার্ক এলাকায় প্রায়ই অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে। অধিবেশনের সিদ্ধান্তে সরকারী ট্রাফিক ব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষ থাকছে। অথচ, শেষপর্যন্ত, গ্রাউণ্ড রিয়েলিটি, পথে পড়ে থাকছে প্রতিদিনের হেরে যাওয়া, ঘামে ভেজা, পিছিয়ে যাওয়ার প্রতিশোধ - গতি। রোড রেজ - দৈনন্দিন পরাভব টুপিয়ে জমা অসন্তোষ, অপারঙ্গমতার হতাশা, ব্যতিক্রমী সফল হয়ে উঠতে না পারার অসহায়তা, দ্বিধাগ্রস্ত সামাজিক টানাপোড়েনের ক্রীড়নক-মুঠো কচলানো যন্ত্রণা, প্রতিবেশের জন্যে ঘৃণা আর স্বশ্রদ্ধার বাড়াবাড়ির কিউমুলেটিভ ফলাফল।
একটা গাড়ি, যা কিনা মোটামুটি আপনার দ্বিতীয় সবচেয়ে দামী জিনিস, যা কিনা আপনার স্টেটমেন্ট অফ সেল্ফ, দেখা যচ্ছে নিয়ম-নীতি-আইন-সামাজিকতার বজ্রআঁটনমাঝে প্রায় একমাত্র মুক্তি, স্বাধীনতা বললে স্বাধীনতা। ভাড়াটে গাড়ির ক্ষেত্রে হয়তো এমনকি পরস্মৈপদী রাজত্ব। ভার্চুয়াল ক্ষমতা আস্বাদ।
জীবনযাত্রার ভাগমভাগের সাথে রিলেট করে ইনোসেন্ট ছাড়পত্র - "আহা, গতিই জীবন এখন' বলে মুখ লুকোবার উপায় নেই। ওভারটেক ঘনঘটা, প্রতিশোধধাক্কা, ফুটপাথে ও রাজপথে পিষে দেওয়া হাত পা আর অঙ্গভঙ্গি-মুদ্রারাক্ষস প্রমাণ করছে, গাড়ি চালাতে গেলেই চেনা লোকটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। শান্ত, সন্তানবৎসল, পত্নীপ্রিয় মানুষটার চোখ লাল, চোয়াল শক্ত, কপালে ভাঁজ, অনুচ্চ স্বরে অশ্লীল অভিশাপ, দাঁতে ঘষে যাচ্ছে দাঁত আর হাত পায়ের অস্থিরতায় জেগে রয়েছে, ক্ষেপে রয়েছে গতি। গতির ম্যাজিক রিয়েলিটি !
এই যাদুবাস্তবের স্পর্শ নিহিত চেতনাস্তরের পরিবর্তন ঘটায়। প্রাণমণ্ডলের সুপ্ত ও অবদমিত অনুভূতিমালার আকস্মিক রূপবদল, অবচেতনের হাতে উঠে আসা চালিকাশক্তি আমাদের অবাক করে। তবু একথা প্রমাণিত - গতি, সভ্যতার স্তরান্তরালে লুকোনো পাশবিকতার আগল খুলে দেয়। প্রতিটি বাঁধা ও অতিক্রমণ আঘাত করে ইগোকে। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, উদারতা, ক্ষমা, সংযম সব সভ্যতার চাদর তখন দিগন্ত দূরত্বে। দুমিনিট আগে গন্তব্যে পৌঁছনোয় যদিও কোনো পুরস্কার নেই, অদৃশ্য জয়মাল্য তবু নিজেকেই নিজের অর্পন। শ্রেষ্ঠত্বের কাল্পনিক নিমেষমুকুট শিরোধার্য করে এইসব মানুষেরা যেখানে থামেন তার পিছনে পড়ে রয়েছে মৃতদেহস্তূপ - আরো কিছু হেরে যাওয়া ইগো, অপমানিত ব্যক্তিসত্বা, অ্যাসফাল্টের গায়ে জমে থাকা থকথকে কালচে রক্ত, রক্তের ছিঁটে মেখে অথচ ছুটে চলা দম্ভটায়ার।
এবং জানা রয়েছে, গতি যেখানে শেষ তার পরেও আরো কিছু বাঁচে জাড্যধর্মে। সুতরাং এই শ্রেষ্ঠবোধ, প্রতিস্পর্ধী দর্প, পথে ও স্টিয়ারিং এ শেষ নয়, আরো কিছু; থেঁতলে যাওয়া লাশের দিকে থুতু ফেলে চলে যাওয়া, পাশ কাটিয়ে যাওয়া দুমড়ানো গাড়িটার, যেটা আর খানিক পরেই চালক ও আরোহীসহ জ্বলে উঠবে বিস্ফোরণে, শোকজের পরের অ্যারোগেন্স, জাস্টিফিকেশনে কৃতকর্মের প্রতি অননুতাপ - জাড্য এই সবকিছুর পিছনেই।
আমরা মনে রাখব, এই আলোচনা সম্পূর্ণত: গতি ও গতিদিব্যতা নির্ধারিত মনস্তত্ব নিয়ে, রোডরেজ ও তার হেতুনির্দেশমাত্র� � এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়ণ-বুলডোজারের কোনো সম্পর্ক নেই - রক্ত ও লাশ কোনো বিশেষ গ্রামের সম্পত্তি নয়, অ্যারোগেন্স ও জাস্টিফিকেশনের কোনো দ্বৈত ইঙ্গিত নেই। মাল্টিন্যশনালে কাজ করে খাই। এখনো বাড়ির দোতলা তোলা বাকি। নিজেকে একটা কম্পিউটার কিনে দিতে হবে শিগগিরি। এখন কোনোরকম রাজনৈতিক কূটকচা৯র মধ্যে আমি নেই। আমাদের ব্যাচের দুটো ছেলেকে মাওবাদী সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শোনা যায়, আর তাদের এখনো কোনো পাত্তা নেই। সুতরাং আমি আর কোনো বিতর্কিত শিরোনামের অংশ হতে চাই না। গতি এখানে শুধুই গাড়ি সংক্রান্ত এবং রোড রেজ-এর অর্থ নিতান্ত আভিধানিক। গতি ও অগ্রগতির সূক্ষ্ম পারস্পরিক অন্তর্লীনতাকে আমি এতদ্বারা সজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করছি। পাঠক করছেন কিনা, লেখাটি পুনর্বার পড়ে দেখছেন কিনা, তার দায় ও দায়িত্ব নিতেও স্বত:ই অসামর্থ্য।
পাঠপ্রবেশকঃ ২৫শে মার্চ, ২০০৭ তারিখে গুরুচন্ডা৯-র কূটকচা৯ বিভাগে প্রকাশিত। কলামের জন্যে এই লেখা ফরমায়েশি, তবে সমসময়ের প্রতি অশ্রদ্ধায় লেখা।
Wikipedia : Road rage is an aggressive or angry behaviour by a driver of an automobile or other motor vehicle. Such behaviour might include rude gestures, verbal insults, deliberately driving in an unsafe or threatening manner, or making threats. Road rage can lead to altercations, assaults, and collisions which result in injuries and even deaths. It can be thought of as an extreme case of aggressive driving.)
বিষয় নিয়ে কিছু বলার থাকেনা, কেননা এই লেখার কিছুদিন আগেই ১৪ই মার্চ নন্দীগ্রাম হয়েছে। রাজ্য ও দেশের, মানুষের অগ্রগতি - গতি - গতির নেশা - গর্ব - Road rage এর সমস্ত লক্ষণের সাথে এভাবে কাঁটায় কাঁটায় মিলে যাবে ভাবিনি। এই লেখা আমার মাথা ঝুঁকে আসা লজ্জার।
রিচার্ড লেয়ার্ড "হ্যাপিনেস" নামের একটা চোদ্দ অধ্যায়ের বই লিখে পেঙ্গুইন থেকে ছাপিয়েছেন বলে নয়, অনির্বাণ চাটুজ্জে সে বইয়ের রিভিউ লিখে এ সংখ্যার গায়েগতরে দেশ-টার দাম তিরিশ টাকা করার পথে সাহায্য করেছেন বলেও নয়, লেখাটায় উন্নয়ন আর জি.ডি.পি.র সঙ্গে সুখে থাকার গুরুচণ্ডা৯য় অসমীকরণের রাজনৈতিক ফোড়ন রিক্যাপিচুলেটেড বলেও নয়, "ব্রেন ফিজিওলজী", "ইলেকট্রোএনসেফ্যা� ��োগ্রাম" আর "ব্রেন স্ক্যান" বিজ্ঞানস্ট্যাম্প� �ুলো মাঠে নেমেই কী-বোর্ড চুলকে দিল। অর্থনৈতিক গবেষণার প্যারামিটার নেওয়া হচ্ছে মানুষের ভালো থাকার বোধটিকে, এবং তা স্রেফ ডিক্লারেশন নির্ভর নয় আর, হাই ফাই যন্ত্রপাতি প্রমাণিত। অর্থাৎ প্রশ্নাতীত একটি থিওরাইজেশনের পথ তৈরি হচ্ছে।=======================================
সুখ কি, কোন কোন ভ্যারিয়েবেলের সাথে এর কেমন ধরণের সমানুপাতিক ব্যাস্তানুপাতিক বা গুণানুপাতিক সম্পর্ক, ম্যারিকার সুখ-সংরক্ষণ সূত্র ও তার এলোমেলোপনার স্ট্যাণ্ডার্ড ডেভিয়েশন মাপা - আপনার পছন্দ হোক বা না হোক, আজকের অর্থনৈতিক রিসার্চের হেভি ডিমাণ্ডেড একটা প্রশাখা। সুখের মত একটা সুক্ষ্ম বায়বীয় বিষয় নিয়ে, যা প্রতিপাদ্য, আপনার নিজস্ব মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই। আপনি মশাই জানেন কি, সুখ কারে কয়? কানের খোল সাফ করে শুনুন, আপনার মাথার বাঁদিকের ইলেকট্রিক চলাফেরা ডান দিকের চেয়ে বেশি হলে আপনি হচ্ছেন গিয়ে সুখী মানুষ। উল্টোটা হলেই আপনার দু:খে চোখের জল ফেলার সময় সমাগত। কূটপ্রশ্নের তালিকা ধরিয়ে দিয়ে, ঘড়ি হাতে, কড়ায় গণ্ডায় উত্তর বুঝে নিয়ে সুখ-অসুখের কোয়ালিটেটিভ মাপামাপির দিন-কে অতএব আলবিদা।
ক্বচিৎ ফিউচারদর্শন
ইত্যাকার কেমিক্যাল লোচা মেপে ফেলার জন্যে সায়েন্স মহাশয় ফুটোস্কোপ বানাচ্ছেন। সুতরাং আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি। অবিলম্বে জানা যেতে চলেছে, বাঁ কানের ঠিক উপরের দুই বর্গসেমি জায়গায় ইলেকট্রিক সিগনালের আধিক্য মানে বিরক্তি (পেছন থেকে বিভু ভট্চাযের টাকে চাঁটি মেরে ব্রেনস্ক্যান করে এটা জানা যায়), কপালের ঠিক মাঝখান থেকে ইলেকট্রিক চলাচলের সাডেন ফল্ - অর্থাৎ হতাশা (কৌন বনেগা করোরপতি' র এক প্রতিযোগী ২৫ লাখ থেকে অডিয়েন্স পোলের লাইফলাইনে ভুল জবাবে ছয় চল্লিশে নামার পর তার এনসেফ্যালোগ্রাম), এমনকি শিরদাঁড়া বরাবর নামতে থাকা ইলেকট্রন স্রোতের হুড়োহুড়ি বাড়া দেখেই বোঝা যাবে সঙ্গমের ডিজায়ার (বিয়েবাড়ি ফেরত ১০০০ কাপল্-এর ইলেকট্রোঅ্যানালি� �িস)। আবিষ্কৃত হতে চলেছে মিনি রিমোট ইলেকট্রোসেন্সর। m r e । ট্রাউসারের পকেটে রেখে বসের চাঁদির দিকে তাক করে যদি বোঝা যায় মুড ভালো (ইলেকট্রোকাউন্ট ৩২ ন্যানোঅ্যাম্পিয়া� �ের কম) তবেই পি. এল. এর অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে এগোবেন। বৌয়ের অজান্তে ঘাড়ের দু ইঞ্চি পেছনে m r e ধরে যদি দ্যাখেন ইলেকট্রোডিডাক্ট ৮৪ ন্যানোঅ্যাম্পসের বেশি, রাতের রান্নার মন খুলে প্রশংসা করুন (বাকিটা বিবাহিতরা বুঝবেন বলে সেন্সর করা হল। ছেলের হৃৎপিণ্ডের ম্যাগনেটোসেন্সর ৫৫ ছাড়ালেই তৈরি হোন, ভাবি বৌমার মুখদর্শন জলদিই হতে পারে।
এহেন ফাজলামি দেখে যাদের বাঁ কানের উপরে ইলেকট্রিক সিগনাল বাড়ছে, তাদের জন্যে সিরিয়াস খবর। গবেষণার বাজার চূড়ান্ত গরম। সেমিনারবিদরা প্রমাণ করছেন, তৃতীয় বিশ্বে গাড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের প্রকৃতিচেতনা হাস পাচ্ছে, যদিও উন্নয়নশীল দেশের মোট প্রকৃতিচেতনা সংরক্ষিত। কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে পরিবেশবিদদের গ্রীণারী প্রোপাগ্যাণ্ডা ও কৃষিজমিবাঁচাও আন্দোলনের সিনার্জিস্টিক এফেক্ট। দুষ্প্রাপ্য নিদর্শণ থেকে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের d n a অ্যানালিসিস রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকৃতিচেতনার আপারলিমিট নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রভূত সাহায্য পাওয়ায় অর্থনীতিবিদেরা বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে ধন্যবাদ জানাবেন নির্ঘাৎ। অধুনা জানা যেতে চলেছে, আরো বহু অজানা তথ্য। যথা: মানুষের এনকোডিং টেনডেন্সি তার জন্মদেশের তুলসিপাতা উৎপাদনের সম্বৎসরিক গড় ভ্যালুর সমানুপাতিক। এভাবে ভারতে প্রাপ্ত কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের ঈর্ষণীয় সংখ্যাধিক্যের হাতে গরম কারণ পেয়ে কর্মসংকোচনজুজু-ভীত বিল ক্লিন্টন জিওফার্মালজিস্টদ� �র তুলসীপাতা নিয়ে গবেষণায় বিশেষ ফাণ্ডিং বিল পাশ করাবেন এবং সাথে সাথে ভারত সরকারের তরফ থেকে রাখা তুলসিপাতা সংক্রান্ত কিছু বিশেষ পেটেন্টের অনুমোদন স্থগিত হয়ে যাবে বলেও আশঙ্কা।
যেহেতু ব্রেনস্থ বৈদ্যুতিক ডিসব্যালেন্সই প্রকৃত প্রস্তাবে সুখ-অসুখের বিজ্ঞান-স্ট্যাম্পিত কারণ, কিছু ফক্কর ছোকরার সাজেশন : হামলে পড়ে উন্নয়ন আর জিডিপির ইক্যুয়েশন না কষে মানুষকে সুখে রাখার জন্যে বৈদ্যুতিক চিকিৎসাপদ্ধতির আসান সমাধান কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাথায় গজাল মেরে ঢোকানো হোক। মস্তিষ্কের বিদ্যুৎব্যালেন্স কর্মসূচী-উত্তর পৃথিবীতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে মাইল মাইল শান্তিকল্যান।
আপত্তি
তাত্বিক আলোচনা ও গবেষণা হামেশাই সুচারু ঘোড়ার ডিম প্রসব করে। বিভিন্ন গামা গামা থিওরিবিদ পরস্পরের অসম্মতিসাপেক্ষ গোছা গোছা গবেষণাপত্রের জন্ম দিয়ে সেমিনারে সেমিনারে লড়াই করে কালাতিপাত করে থাকেন, এবং তাতে আমজনতার কিৎসু আসে যায় না, কারণ, স্বীকৃত যে, গো-এষণা শেষে খুঁজে পাওয়া গরুটি সবসময় হারানোটি নাও হতে পারে। কিন্তু মানুষ, যার কিনা - ধারালো নখ নেই, তীক্ষ্ম দাঁত নেই, ঝাঁঝালো নাক নেই, দূর-দৃষ্টি নেই, খাড়া কান নেই, নেই পেশীর দোকান - তার মা, ব্র্যাকেটে বিজ্ঞান, আছে। বিশ্বাসযোগ্যতার শেষ প্যারামিটারটিকেও রেহাই দেওয়া হল না। i s i এর মতই রণে বনে খাটে ও কমোডে জন্মানো সমস্ত থিয়োরির ওপরে এবার লাগাতে হবে এই বিজ্ঞান স্ট্যাম্প, এবং আমরা, অত:পর বিশ্বাস করতে বাধ্য হব, হেনস্ প্রুভড, যে হারানো গরুটিকেই খুঁজে পাওয়া গেল।
পুজোয় আজকাল খুব ভয়ে থাকি। টেনশন। কে কখন টেনে নিয়ে চলল ঠাকুর দেখতে। ব্যাস। গেল ঠিভি দেখার বারোটা বেজে। বেজায় সাবধানে থাকি।
বাকি বচ্ছরভর কোনো ঝামালি নাই। কোনো টানাহ্যাঁচড়া নাই। সকালে ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে টিভি খুলে বসে যাও, স্নান করে খেয়ে নিয়ে ঘুম পাওয়া অবধি ঘন্টা দুয়েক, আর সন্ধ্যে থেকে টানা রাতে খাবার আগে পর্যন্ত। সব ঠিকঠাক, কেবল পুজোর ক'টা দিনই সমস্যা। মন্ডপে গিয়ে ঠাকুর না দেখলেই লোকের প্রাণ আই`ঢাঁই করবে। কেন বাপু? টিভিতে কি ঠাকুর দেখায় না? বরং আরো ভালো করে দেখায়। প্রতিমামুখ ক্লোজ`আপ করে, প্যাণ্ডেলের ভিতরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, রাস্তায় আলো ঝকমক - এরচেয়ে ভালো আর কী দেখা যাবে গুচ্ছের ভিড় ঠেলেঠুলে? আরো সমস্যা, এই পুজোর চক্করে পড়ে রিয়েলিটি শো গুলো মিস হয়ে গেলে। ঘরে বসে অ্যাডের ফাঁকে কিছুক্ষণ পুজোপরিক্রমা দেখে নেওয়াই যায় কিন্তু কুচোকাঁচারা টানতে টানতে মন্ডপে নিয়ে গেলেই চিত্তির।
আসলে এত ভালো ভালো প্রোগ্রাম দেয় টিভিতে আজকাল। সিরিয়াল তো আর দেখাই হয় না। আগে হিন্দিগুলো দেখতাম, এখন তো বাংলা চ্যানেলগুলো ও ভরে গেছে রিয়েলিটি শো-এ। আমার তো দারুণ লাগে। এক্কেবারে বাস্তব ঘটনা সব দেখায়। সামনাসামনি। কোনো নকল নেই। স্ক্রিপ্ট করে, চিত্রনাট্য করে মেকি কান্না আর মিথ্যে অভিনয় নেই। সব একদম যেমনটি, তেমনই দেখা যায় টিভিতে। আজকাল বানানো জিনিস দেখতে মোটেই ভালো লাগে না। কেমন যেন ঠকাচ্ছে ঠকাচ্ছে মনে হয়। সেই 'এম টিভি বকরা' বা "ছুপা রুস্তম'এ যখন রাস্তার লোককে ধরে ধরে বোকা বানাতো, এত্ত মজা লাগত দেখতে। ওরা কেউ কক্ষনো ধরতেই পারত না ওদের টিভিতে দেখানো হচ্ছে। কি বোকা বোকা লোক সব রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় ভাবলেই হাসি পায়। প্রাণ ভরে হাসি আমি। তারপরে যখন কৌন বনেগা ক্রোড়পতি দেখাতো! কতবার চোখ বুজে ফেলেছি, বিড়বিড় করে ঠাকুর ঠাকুর ডেকেছি, যাতে লোকটা প্রশ্নটার ঠিক উত্তর দিয়ে দেয়। "ইট ইজ দ্যা রাইট আনসার' বলে উত্তরটা সবুজ হয়ে গেলে কি যে স্বস্তি হয়! দমচাপা উত্তেজনা শেষে একটা বড় শ্বাস ফেলি। সেই কবে থেকে মন দিয়ে দেখি ইন্ডিয়ান আইডল, সা রে গা মা পা। গেম শো আর রিয়েলিটি শো তো মিলে মিশে একাকারই হয়ে আছে। ফেম গুরুকুল, বিগ বস, নাচ বলিয়ে, ঝলক দিখলা যা - এর কোনোটাই ছাড়া যায়, বলুন? এলিমিনেশন রাউন্ডটা প্রচন্ড টাচি হয়। আমার মতো একটু সংবেদনশীল মন হলে আপনার চোখ জলে ভরে আসবেই। অতগুলো এপিসোড লড়ে আসার পর যখন একটা ছেলে বা মেয়ে চলে যায় তখন কেমন একটা আত্মীয়বিয়োগের ব্যথা হয়। প্রতিযোগীদের চোখে জল দেখলেই আমি আর থাকতে পারিনা। আমারও চোখ ভিজে আসে। সেদিন দেখাচ্ছিল কী গরীব ওরা, ধার শোধ করবে বলে ই এম আই খেলতে এসেছে। হেরে গেল। এখন ওদের কী হবে? মীরাক্কেল খেলতে আসার জন্যে যে ছেলেটার নাম কাটা গেছিল স্কুল থেকে? ওর কী হবে। এইজন্যেই চেয়েচিন্তে একটা মোবাইল নিয়েছি। প্রচুর এস এম এস করি তো আমি। কালকেই ই এম আই এর মেয়েটার জন্যে ৫০ টা এস এম এস করেছি। প্রচুর ফোন করি সারাদিন, টিভিতে দেওয়া ফোন নম্বরে। রোজগেরে গিন্নি, বেটা বেটির ব্যাটেল, মা vs বৌমা - যদি পার্টিসিপেট করা যায়।
দাদাগিরি, ড্যান্স বাংলা ড্যান্স, ই এম আই, ধুম মচা দে, সুকন্যা পাড়ায় পাড়ায়, ধা-এ ধামাল, কিচ্ছু বাদ দিই না। বুগী য়ুগী, ফিয়ার ফ্যাক্টর, এম টি ভি রোডিজ, রাখিকি স্বয়ংবর, খতরো কা খিলাড়ি প্রত্যেকটাই দেখতাম আর দেখি। কত মানুষের কথা জানা যায়। সেদিন যেমন দেখালো একটা মেয়ের ছোটোবেলায় এক ফুচকাওয়ালার সাথে প্রেম ছিল। বাবা জানতে পারায় ব্যাপারটায় ওখানেই চুকে যায়। সেই ফুচকাওয়ালাকে এত দিন পরে আবার খুঁজে এনে টিভিতে, মঞ্চে তোলা হল। ভাবুন! মানুষের জীবনেও কত পরিবর্তন আনতে পারে এই রিয়েলিটি শো। সেদিন আমি নিজেকে একদম সামলাতে পারিনি। চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে হাততালি দিয়ে উঠেছিলাম। ওরা সবাই পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছিল কি হয়েছে দেখতে। বললাম সব, কী অসাধারণ ব্যপার!
সাচ কা সামনা দেখতে দেখতে তো মাঝে মাঝে নিজের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়াই আমি। এই প্রশ্নের জবাব কী দিতাম আমি, সত্যি কথা বলতে পারতাম? আমি নিজেই কি জানি সত্যি কোনটা? যন্ত্র রাখা হয়েছে তো ঐ জন্যে। একেবারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জেনে বলে দেবে আমার জীবনের সত্যিগুলো, আমার অনুভূতি, ইচ্ছেগুলো। যেগুলো হয়তো আমার কাছেই এখনো পরিষ্কার নয়। ভাবতেই শিউরে উঠি। উঃ! এই দেখুন গায়ে পদ্মকাঁটা!
পুজো এলে তাই আমি একটু ভয়ে থাকি। সাবধানে থাকি। বেয়াক্কেলে ডাকে যেন কোনো রিয়ালিটি শো না মিস হয়ে যায়। ঐ অনুষ্ঠানগুলোই এখন প্রায় জীবন আমার। আরো নিয়মনিষ্ঠ হয়ে উঠি টিভি চালানোয়। সন্ধ্যেবেলার টিফিনটা নিজের ঘরে এনেই খাই, রোজগেরে গিন্নি দেখতে দেখতে। তাছাড়া বাইরে বেরোলেই ভয়। এই সেদিন তিন্নিদের বাড়িতে যা হল। ওরা ঠাকুমাকে বাড়ি দেখতে রেখে এক সপ্তাহের জন্যে ঘুরতে গেছিল পুজোর ছুটিতে। ফিরে এসে দরজা খুলে পেল বুড়ির পাঁচ দিনের পুরোনো লাশ। পঁচ ধরে গেছে। আমার শীত করে। আমি টিভির ভল্যুম বাড়িয়ে দিই। সৌরভকে দেখি ভালো করে। কি আত্মবিশ্বাস, কি সরল ভালোমানুষ ছেলেটা, গুগলির প্রশ্নগুলো মনে রাখতে চেষ্টা করি। ভীড়ে বেরিয়ে কি হবে! কালকেই শুনলাম রুষিরা কলেজ স্কোয়ারে ঠাকুর দেখতে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে পড়েছিল। কেউ প্রচন্ড জোরে ওর বুক মুচড়ে দিয়েছে। বাড়ি এসেও ফোঁপাচ্ছিল মেয়েটা, তেরো বছর বয়স, ফ্রক খুলতে তখনো নখের দাগে রক্ত জমে লাল দাগড়া হয়ে ছিল ওর বুক। আমি সরে আসি তাড়াতাড়ি। চ্যানেল ফিরিয়ে খুঁজে বের করি কোথায় প্রশ্নের উত্তর বললেই লাখ টাকা। কোন প্রতিযোগী ছোট্টোবেলা থেকে ফড়িঙের ডানা জমায় কাঁচের বয়ামে। রতনের শ্বশুড়মশাইয়ের মাইনের গোটা টাকাটাই সেদিন ছিনতাই হয়ে গেল। দুজন সতেরো আঠারো বয়সের ছেলে নাকি, মুখে রুমাল বেঁধে একটা বিশাল ছোরা হাতে ওকে একটা পাঁচিলের ধারে নিয়ে যায়। উনি বাধা দিয়েছিলেন বলে ওরা বুকের আড়াআড়ি হাত চালায়। ১২ টা স্টীচ পড়েছে ভদ্রলোকের। নাচ বাংলা নাচ কোন চ্যানেলে হচ্ছিল? আমি এত ভুলে যাচ্ছি আজকাল। চ্যানেল স্ক্যান করতে দিয়ে দিই। ধুস, সব জায়গায় অ্যাড। নিত্যদের বাড়ির সব সময়ের কাজের মেয়েটা কোন এক ড্রাইভারের সাথে ভুল করে। ও ভেবেছিল ভালোবাসা। ছেলেটা একটা ঘর ভাড়া করে পাঁচজন বন্ধুর সাথে এক সপ্তাহ ধরে সুমির সাথে জোর করে, তারপর পালিয়ে যায়। দেশে যাওয়ার নামে ছুটি নিয়ে এক সপ্তাহ পর সুমির খবর পাওয়া যায় হাসপাতাল থেকে। রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। আরো তিন দিন কোনোরকমে বেঁচে থেকে অবশেষে মেয়েটা মুক্তি পায়। ওর মা নাকি বেডের লোহায় মাথা ঠুঁকে ঠুকে কাঁদছিল। আমি ভালো করে দেখি নীলোৎপলের মায়ের কান্না। ছেলে ফাইনালে উঠে জাজেদের সিদ্ধান্তে ছিটকে যায় বলে মহিলা কাঁদছিলেন। নাঃ অতটা ফুঁপিয়ে নয়, সুমির মা নিশ্চয়ই হাহাকার করছিলো। চেঁচিয়ে অভিশাপ দিচ্ছিল ভগবানকে, অদৃষ্টকে।
খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি। টিভির নিউজ চ্যানেল ও দেখিনা পারতপক্ষে। কখনো চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে কোনোভাবে দু এক টুকরো খবর কানে ভেসে আসে যদি, এই ভয়ে মিউট করে চ্যানেল বদলাই। কোথায় টিফিন বাক্সে ভরা বোমা ফেটে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মরে গেল, কোথায় অ্যাকসিডেন্টে নদীতে পড়ে গেল গোটা বাস, রাষ্ট্রদূত অপহরণ, ভোটের আগে পরে খুন - এ খবর শুনে আমি কি করব? আমি মন দিয়ে দেখি রাহুলের সঙ্গীরা কি বলছে, বিগ বস-এ কে টিকে থাকবে শেষ পর্যন্ত? দুজন মেয়ে পার্টিসিপেন্ট দুজনের সম্বন্ধে কি বাজে ভাবে বলল। ওরা কেউ একে অন্যকে সহ্য করতে পারছে না, দর্শকরা কী বলবে ? আমি ঋতুকে ভোট দিই। যদি একটা এস এম এসে কাজ না হয়, দুটো ভোট দিই। সেলিব্রিটিদের গানের প্রতিযোগীতায় দর্শকরাই জাজ। এটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। নীলুদের বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট হচ্ছে। নীলুর মা কিছুতেই জমিটা ছাড়তেন না, কিন্তু কিছুদিন বাড়িতে লোক আসা আর ধমকানির পর রাতে ওরা দরজায় ঢিল মারতে শুরু করল। নীলুকে একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে দুজন মারধোর করল। কালীপুজোর আগেই ফ্ল্যাটটা হয়ে যাবে। কেমন লাগে কোনো বিধবার, রাতে নাবালক ছেলে নিয়ে শুয়ে থাকাকালীন ঘরের দরজায় জানলায় ইঁট পড়লে? টিনের সানশেডে পড়া আধলা ইঁটের শব্দে, সদর দরজায় কাচের বোতল ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে? পুকুরপাড়ে মিলনীর মাঠে রাতে নেশা করত পাড়ার পাঁচ ছটা ছেলে, মাসখানেক আগে তাদের একজন কে সাপে কামড়ায়। কাল অমিয়াদের বাড়ি যেতে হয়েছিল একটু, স্টেশন থেকে ফেরার পথে দেখলাম জল জমা মিলনীর অন্ধকার মাঠে আলো জ্বলা প্যান্ডেল, প্রতিমা আর প্লাস্টিকের চেয়ার গুলোকে সাক্ষী রেখে রাশি রাশি ব্যাং ডাকছে। অবিশ্রান্ত। একটাও লোক ছিলনা, শুধু ব্যাঙের ডাক। আমি ভাবছিলাম সেই সাপটা কি এখনো এই মাঠেই আছে? কোনো কোনায়? একসাথে এতগুলো ব্যাঙের ডাকে সে কি আনন্দ পাচ্ছে, নাকি ভয়? আমি তাড়াতাড়ি হাঁটা দিই। শালবাগান তিন নম্বরের প্যান্ডেলটা খুব সুন্দর হয়েছে। রংচঙে, চমকদার। অত রাত্রে ঐ জমকালো প্যান্ডেলের মধ্যে দুটো কালোকুষ্টি নোংরা মশারী টাঙিয়ে দুজন লোক শুয়ে আছে। ঢাকীরা বোধহয়। কয়েকলাখ টাকার পুজোর ঠাকুর বিসর্জনের পর একাদশীর সকালে ওরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঢাক বাজিয়ে বকশিসের জন্যে হাত পাতবে। কালো, শক্ত, শিরা ওঠা হাত, যার পাতায় কোনো ভাগ্যরেখা নেই। সেই হাতে, ছোঁয়া বাঁচিয়ে, একটা দশ টাকার নোট ফেলে দিয়ে আরেকটা দশটাকা না দেওয়ার কারন দেখিয়ে বরুণের বৌ কুড়ি মিনিট ঝগড়া করবে, গজগজ করবে। আমি তখন টিভির ভল্যুম বাড়িয়ে দেবো। দর্শকের, প্রতিযোগীর, জাজেদের একটাও কথা তখন মিস করা সম্ভব নয়। আমার দরজাটা ভিতর থেকে খুব আঁট করে বন্ধ করে রাখবো, যেমন রেখেছি পুজোর এই দিন ক'টা।
বাংলালাইভের শারদীয়া i-পত্রিকা ১৪১৩ (২০০৬) তে প্রকাশিত।
লেখাটা কেমন হয়েছে পাঠক জানেন, তবে আমি চিরকৃতজ্ঞ সম্পাদকের কাছে, সূচীপত্রে যাঁদের নামের পাশে আমার নাম রাখতে তিনি ভরসা পেয়েছিলেন।
বড় গর্বের জায়গা আমার, তাই সূচীপত্রটাও দিয়ে দিলাম। আশা করি কেউ ভুল বুঝবেন না, এ নিছক আবেগের বশে, কোনো ঢাক পেটানোর অভিপ্রায়ে নয়। i-পত্রিকা আর্কাইভ ঐ সাইটে এখন আর পাওয়া যায় না।
![]()
১
আসল কথাটা হল - মার্কেটিং। কি ভাবে বেচবে? সহজ উপায় - সমস্ত বিজ্ঞাপণওলারাই কোনো না কোনো সময় ব্যবহার করে করেই সহজ করেছেন যদিও - একটা কিনলে আর একটা ফ্রী। মানে কলেজপ্রেম দেখতে এলে সাইকেল রেস ফ্রী, ইংরেজের সাথে চাষীদের মাথাফাটাফাটি দেখতে এলে ক্রিকেট ম্যাচ ফ্রী। এমনকি জ্যাকি চ্যন ও এই মাত্র "দি মিথ" ছবিতে মল্লিকা শেরাওয়াতকে টেনে হিঁচড়ে শেষতক আর্কিওলজিস্টের খোঁজাখুঁজির সঙ্গে রাজা রানী সেনাপতি আর ঘোড়া তীর তলোয়ার যুদ্ধ ফ্রীতে দিয়েছেন। রং দে বাসন্তি দেখতে গিয়েও - ২৬শে জানুয়ারি - ভগৎ সিং পেলাম মিনি মাগনা। পয়সা উসুল। মার সিটি। অ্যায়স্শালা।
২
বোঝাবুঝি, মানে বই লিখন, অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে তীব্র বিতণ্ডা - কে পাগল বলে বুঝিয়ে দে বুঝিয়ে দে, কে আঁতেল বলে অ্যাই! বোঝালি ক্যান্? কিন্তু সে বাওয়াল সাহিত্যের অক্ষরমালায় পরিপাটি সাজিয়ে রাখা হোক, মাছ কিনতে বাজারে গিয়ে কমলকুমার আওড়ালে দামড়া খিস্তি বেটে কানে মাখিয়ে দোবো, সে কি ভালো হবে? তো, ডিস্ট্রিবিউটারের নিমের পাঁচন মুখ দেখতে না চাইলে যুগের ঝকঝকে ফেস্টুন : অ্যাটাচ ইওর মানেবুক। বুদ্ধদেব বাবু পর্যন্ত উত্তরা তৈরি করে বেঁটে গার্ডসাহেবকে দিয়ে বলিয়ে রাখেন - আমাদের দেশে আসো, এখানে কেউ লম্বা নয়, আমরা সবাই বেঁটে। কোন স্বপ্ন কেন দেখছো বলে দিতে ভূতের সিনেমা মাত্র হাতের কাছে মজুত দিগগজ মনোবিদ। আর আজকের প্রতিটা মুহূর্তকে ইন্টারপ্রীট করতে দ্বারে বসি আছে সাদাকালো ইতিহাস ফিল্ম।
বাল্যে মানে বই কিনবে কিনা - স্বচয়েস। ফির, ইংলিশ টেক্সট ও মানে বই একত্রে। চাইলেও সে ফেভিকল জোড় খুলতা নেহি। কেউ বলুক দেখি, আমি লার্নিং ইংলিশ বাজারে পেয়েছি মানে বই ছাড়া! পর্ষদ এক্ষুনি দুহাত জিভ কেটে দেখিয়ে দেবে - হয়না। এখন আর অত ঝামালি নাই, বইয়ের মধ্যেই মানে বই লেখা হচ্ছে। তাতে আয়তন ফুলে ফেঁপে ধুমসো। বয়েই গেল। টিভি দেখা বাঙালী ব্যাপক খুশি। মাথা চুলকালেই চুল ঝরছে যখন, এমত কালো সময়ে এ তো আশির্বাদ। টিভি দেখে দেখে যারা চিন্তা-ভাবনা করবার প্রক্রিয়া ও প্রচেষ্টার পশ্চাতে দিবানিশি সপাটে ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ ঝেড়ে চলেছেন, এবং যে গ্রামদেশব্যপী গণ্ডারের তাচ্ছিল্য বিকিরনে টানা হয় আর্ট ও মাস ফিল্মের মার্জিন, সিনেমা বিকোতে চাইছেন তাদের কাছেই, যেহেতু গ্লোবালাইজড মানিমার্কেটের ক্ষেতে সব ধান তারাই ফলিয়ে রেখেছে - ইজারা নিয়েছে এ গ্রহের বাণিজ্যের। রং দে বসন্তি তাই আঙুল বোলানো মানে-বইয়ের চাষ করেছে। একটা সীন দেখিয়েই অনিবার্য পরের সীনটায় তার অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। তাবৎ ভারতীয় মোগাম্বের মতন গাম্বাট খুশিতে ডগোমগো - দ্যাখ দ্যাখ পুরোটা বুঝেছি। একি আক্স ? যেখানে বচ্চন আর বাজপেয়ী তুমুল সুররিয়ালের মধ্যে খেলা করেন - এই ভাসেন, এই হারিয়ে যান? এ হল আইনক্স জেনারেশনের ছবি - চোখে আঙুল গেঁদে দেখিয়ে দেওয়ার নাম বাবাজী। সুতরাং হল থেকে বেড়িয়ে বিন্দুমাত্র আঘাত না খাওয়া ইগো, কিছু করিতে হবে, আজি মরিতে হবে - গুনগুনিয়ে থমথমে বাইকে স্টার্ট দেয়, আর চুলে হাওয়া লাগলেই যেহেতু খুলে খুলে যায় মন, ভেতর থেকে ভুস করে টুকি মেরে যান এ . আর . রহমান - অ্যায়স্শালা।
৩
প্রশংসা করতেই হবে যিনি স্ক্রিপ্ট লেখেন। ধুরন্ধর হাত। সত্যজিৎ রায় একবার সন্দেশে চিত্রনাট্য লেখা শেখাচ্ছিলেন। আজ ২০ শে ফেব্রুয়ারি। গল্পের প্রথম লাইনটা এরকম দিব্যি লিখতে পারেন কিন্তু এটা যদি চিত্রনাট্যের প্রথম লাইন করতে হয়? ঘাম ছুটে যাবে মশাই ক্যমেরা দিয়ে আজকের ডেট দেখাতে। আমদানী করতে হবে এমন কোনো ঘড়ি যার গায়ে তারিখ লেখা থাকে। কিংবা ক্যালেণ্ডারের ২০ তারিখে ক্যামেরা ফোকাস করে বাকি সংখ্যগুনো ফেড করে দিন। কিংবা এক দিনের ছোট ক্যালেণ্ডার গুনো আমদানী করে কাউকে দিয়ে পাতা উল্টে ২০ তে স্থির করুন। অথবা সকালের যে কাগজটা ছুঁড়ে দিয়ে গেল হকার, তার তারিখ লেখা লাইনটায় ক্যমেরা নিয়ে যান। এত্ত ঝক্কি। "রাম ভালো ছেলে" - লিখে ফেলা যত সহজ, সেটাকে ক্যমেরা দিয়ে প্রমাণ করতে আপনাকে খান তিন চার ঘটনার ক্যামেরালভ্য সীন লিখতে হবে, যাতে প্রমাণ হয়, "রাম ভালো ছেলে"। তেমনি গল্পকার তো লিখেই খালাস : ""যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি শুরু হল""। সেটাকে ব্যাকগ্রাউণ্ড ন্যারেশন ছাড়া ক্যমেরায় বোঝায় কার সাধ্যি। এ ধুমসো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় কাছা গুটিয়ে নেমেছেন আমাদের স্ক্রীপ্ট রাইটার। আগে ইতিহাস দেখালেন - সাদা কালোয় - স্বাধীন সংগ্রামীদের স্কুলপাঠ্য ইতিহাস। তাপ্পরে দেখালেন ঘটমান বর্তমান - প্রেজেন্ট টেন্স। অত:পর আবার ফ্ল্যাশব্যাকে সাদা কালো সেপিয়া রেফারেন্স। কান পাকড়ে বুঝিয়ে দোবো। চালাকি? এরে কয় ইতিহাসের পুনরাভিনয়। এর পাশেই মনে পড়ে, অকারণেই, হাম দিল দে চুকে সনম - এ ঐশ্বর্য রাই দু হাতের শিরা খচাৎ কেটে ডুবিয়ে দিলেন গেরস্তালি সুইমিং পুলে, এরপর ভেসে উঠবে ওয়ার্ডআর্টে লেখা "INTERVAL ". সুইমিং পুলে কেন? জল যখন লাল হয়ে যাচ্ছে আপনি ভাবলেন আর্ট করার গিমিক। এবার সিনেমা শেষে বাইকে স্টার্ট মেরে ই হঠাৎ মনে পড়ে গেল আর্রে! সেই যখন হাতের আঙুল সামান্য কেটে গেছে কি যায়নি, সলমনের সাথে ঐ জলেই না ডুবিয়ে ধরেছিল আঙুলটুকু? আর আপনি বোবা হয়ে যান। পুনর্বার অবিশ্রান্ত মনখারাপ চোখে ভর করে। যখন আঙুল থেকে খুলছে না বিয়ের আংটি, শক্ত হয়ে এঁটে গেছে বলে গুণ্ডাদের ডিসুম গুলি টুলি খেয়ে যাচ্ছিলেন অজয়, হাসপাতালে ঐশ্বর্যের চিকিৎসার টাকার জন্যে যখন সেই আংটিই অনায়াসে আঙুল থেকে বের করছেন, আবার পরছেন, অস্থির পায়চারি সঙ্গে - দেখছেন ঐশ্বর্য, আর নিজের মঙ্গলসূত্র খুলে দিচ্ছেন একবারও না রুখে, কোনো ফ্ল্যাশব্যাক সাহায্য করেনি আপনার স্মৃতিকে। মিঠুন সুস্মিতা সেনের দিকে তাকালে, চিংগারিতে, ক্যামেরা যেন দৃষ্টি হয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামে সুস্মিতার বুক থেকে পেটে, অপেক্ষা করে কখন আঙুল কচলানো থেমে সরে যাবে হাতদুটি আর পর্দা জুড়ে জেগে উঠবে অদাহ্য অসহ্য নাভিটি; অথচ মনে পড়ে প্রতিদ্বন্দী, ধৃতিমান মেয়েটিকে ঝারি মারছে বোঝাতে তার শরীরটুকু ইঞ্চি ইঞ্চি মাপার দরকার হয়না ক্যামেরার।
অর্থাৎ আমি একটা কৌশলের কথা বলছি, একটা পড়ার কায়দার কথা, রং দে বাসন্তী যার বিপ্রতীপে দাঁড়ায়। সূক্ষ্ম সাজেশনে দর্শকের মাথাকে কাজ করতে দিয়ে সেখান থেকে জায়মান বোধ, বোঝাবুঝির ফসলে মানসিক উৎকর্ষের গোলা ভরার কথা - রং দে বাসন্তি যাকে আর্ট ফিল্ম ফ্লপ হওয়ার সহজ আঁতেল ফরমূলা বলে বাতিল করে। তবে এই সিনেমার বর্ম কই? অস্ত্র কি? আর দশটা বাজার চলতি হিট ছবির থেকে নিজেকে আলাদা করার মন্ত্র কি? আমরা তার মানে ছবিটার ভিতরে ঢুকতে চলেছি। ড্রাইভ দিতে প্রস্তুত? দাও তবে লাফ! অ্যায়স্শালা।
!!! লুস কন্ট্রোল !!! লুস কন্ট্রোল !!!
ইইইইইয়াআআআআআআহ
!!! লুস কন্ট্রোল !!!
আপ্নি তো পাঠশালা মস্তি কি পাঠশালা
পায়ের পাতা বেয়ে, নখ বেয়ে রোম বেয়ে ছুটে আসছে কাঁপন, নাচ - Live Life, Don't analyze it . ইইয়েস্স । লুস কন্ট্রোল !!!
মানুষ গৌতম বুদ্ধ, মহম্মদের কথা শোনে না, কিন্তু মায়ের বারণ মানে, খ্রীষ্ট রামকৃষ্ণের কিতাববদ্ধ কচকচি উল্টোয় না, কিন্তু বান্ধবীর কটাক্ষে সিগারেট নিভিয়ে ফেলে। নানক কি জরাথ্রুষ্টের সারমন শোনার আগেই বন্ধুর কাঁধে হাত রাখে, দুজনে এগিয়ে হয়তো অন্ধ মানুষটাকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিয়েও আসে (ইয়ে, তাঁর সম্মতি নিয়েই)। অর্থাৎ যে সম্পর্কগুলো সে নিজে তৈরি করে, তাদের সে একটু বেশি গুরুত্ব দেয়। সে দিন গিয়াছে, যখন রুপুলী পর্দায় বীর দেশপ্রেমী হুঙ্কার দিল - আয় আমায় রক্ত দে, পাব্লিক ক® প্যথোস উছলে কোরাসে "নে, নে, নে।" আজ এই ২০০৬ সালে পর্দায় দাঁড়িয়ে লেকচার দিতে থাকুন, আমরা বেড়িয়ে দুটো সিগ্রেট টেনে, এক গ্লাস ঠাণ্ডা কিনে, ফাঁকে কাউন্টারের মেয়েটাকে ঝারি মেরে আসব। (এবং এই কথাটাও আমি কিছু হঠাৎ বললাম না, ছবিতে অনুপম খেরই বলছেন - "" sms জেনারেশন, দো লাইন এক্সট্রা কেয়া বোল দিয়া লেকচার লাগতা হ্যায়"" )অথচ রাঙ্গ দে বাসন্তি চামচে করে গুনে গুনে নীতিশিক্ষা গিলোচ্ছে আর দেশসুদ্ধু লোক গ্লবগ্লবিয়ে গিলেছে - কি ব্যাপার? ট্যান যাবার ব্যপার নাই। তরমুজের শাঁস এটাই, গোটা সিনেমার বটম লাইম একখানাই - "কোই ভি দেশ পারফেক্ট নেহি হোতা। উসে পারফেক্ট বানানা পড়তা হ্যয়। পুলিশমে ভর্তি হোঙ্গে, মিলিটারি জয়েন করেঙ্গে, IAS বনেঙ্গে, পলিটিক্স কা হিস্যা হোকে ইয়ে সিস্টেম কো বদল দেঙ্গে। ইয়ে দেশ বদলেগা। হাম বদলেঙ্গে ইসে।" তাও একবার নয়, দুবার রিপীট হয় এই ডায়লগগুচ্ছ, যেমন রিপীট হয় প্রভূত সীন, প্রভূত সেপিয়া সিন। এ দরকচা মারা পুরোনো জ্ঞানের নড়ি, ডবল দাড়ি পব্লিকে তবে গিলছে কেন? এই তো বুঝেছেন, এ প্রফেটের সাদা দাড়ি নি:সৃত বিড়বিড় নহে, আমার বন্ধুর স্বগতোক্তি। হ্যাঁ বন্ধুত্ব, তিন ঘন্টা ধরে যে রিলেশনটা তৈরি করল অন্ধকার ঘরে প্রত্যেকের সঙ্গে ওয়ান ইস টু ওয়ান - রাঙ্গ দে বাসন্তি - স্রেফ অনৈশ্বর বন্ধুত্ব।
কলেজ - আড্ডা - চ্যাংড়মো - বাওয়াল - মস্তি ইত্যাদি নিয়ে কম সিনেমা হয়নি হিন্দিতে। স্মার্টনেস তাদের অনেকেরই নির্ভুল তাবিজ। কিন্তু একটা সিনেমা জুড়ে চরিত্রগুলোর সাথে রিলেশন তৈরি করার ক্যালি কতখনি এর অগে দেখিয়েছে বলিউড? ধরা যাক "দিল চাহতা হ্যায়"। বন্ধু সংখ্যা মোটে তিন। তাদের বাওয়ালিও আবার ঘুরে ফিরে মহিলাগন্ধী। বন্ধুত্বের মধ্যেও চোখে পড়ে, বড় হয়ে দাঁড়ায় ইগো - বন্ধুত্বকে গ্রাস করে - আর বড়লোক বাপের ব্যাটাদের এলিট ফুর্তি দেখে মজা পাই আমি, হাসিও কখনো, কিন্তু ওদের আমার বন্ধু ভাবতে পারি কি ঠিকঠাক? "স্টাইল" তো আল্টি একটা কমেডি-থ্রিলারই হয়ে গেল - বন্ধু হবার জন্যে চরিত্রগুলোকে ভাঙলও না বিন্দুমাত্র। যুবা তিনজন আলাদা মানুষের গল্প, যাদের দুজন পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্বের সুতোটাই প্রায় অধরা, লীডার-অনুগামী যেন - বাকি তো প্রেম আর প্রেমের পরত পরত উন্মোচন। খুব চেষ্টা করেও মনে পড়ছে না আটজন ছেলেমেয়ের বন্ধুতা ফোকাস করতে করতে একটা সিনেমা তৈরি হয়েছে শেষ কবে।
আমি জীবনে দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে ছাড়া এই মাত্র একটা সিনেমা হলে নিজের পয়সা খরচ করে স্বেচ্ছায় দ্বিতীয়বার দেখলাম। নিজেই অবাক। হতে পারে এখন হাতে টাকা পয়সা আগের চেয়ে কিছু উদ্বৃত্ত, তবু দেখতে এই যে ইচ্ছেটা হল, এটা তো মিথ্যে নয়! প্রথমবার প্রোমো দেখা মন খুব সন্দিগ্ধ, প্রতিটা দৃশ্যপট বদলের আগেই ভেবে নিচ্ছে এর পরে কি হবে, মাথা কাজ করছে প্রতিটা ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল থেকে খুঁজে নিতে পরিচালকের চোখটুকু, আর কি আশ্চর্য রকম প্রেডিক্টেবল প্রতিটি দৃশ্য, ঘটনা, রিঅ্যাকশন অনিবার্য মিলে যায় (যখন মিগ বিমান দুর্ঘটনার অন্য অন্য খবর শুনে টিভি বন্ধ করে দেয় ছেলেপুলে বোর হয়ে, অথচ মোহন যোশীর মুখ টিভি পর্দায় ভেসে উঠে বলে দেয় গল্প এই দিকেই গড়াবে, ইত্যাদি আরো অনেক অনেক)। হল থেকে বেড়িয়ে পর্যন্ত মনে হয়নি আবার দেখব, অথচ একটা টান, জানিনা কেন ( " Live Life, Don't analyze it. " ) আবার নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল সেই হলে, কাঠের চেয়ারে এবার, যেমন রিইউনিয়নের দিন কলেজে ফিরে যাই, স্কুলের বন্ধুদের মেল করি বাড়ি ফেরার আগে - আসছিস তো? মাঠে? সেই আগের মতো আড্ডা দেবো অনেক রাত অবধি, মশারাও কাম্ড়াতে কামড়াতে ক্লান্ত হয়ে যাবে - আসবি তো? দ্বিতীয়বার দেখতে গিয়ে তাই একটু বেশিই জোরে হেসে ফেলি, আগেরবারের চেয়েও, কখনো কখনো।
কিভাবে বন্ধুত্বটা তৈরি হয়? চারজনের কোনো ব্যাকগ্রাউণ্ড দেখায় না সিনেমাটা। হয়তো হস্টেলবাসী। বাকি চারজনের দুজনের বাবা নেই, দেশের মাটিতে কুরবান। আর দুজনের বাবার সঙ্গে ছেলের ঝগড়া - বা বোঝেন না ছেলেকে। একজন ড্রয়ার থেকে মায়ের ছবি বের করে কখনো দেখে একঝলক, আরেকজন বাপ-দাদার কমিউনালিত্বে জেরবার। সোজা কথায় আটজনের কারোর পিছনেই কোনো স্ট্রং ঠেকনা নাই, যার পরিপূরক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বন্ধুসঙ্গে। দুজন স্নেহশীলা মায়ের সাথে সুখী - যে স্নেহের ভাগ পেয়ে বাকিরা ভিজতে চায় অক্লেশে, আর এই মানুষজন্মের সব টান সব বাঁধন এসে পড়ে বন্ধুত্ব- এই শব্দটায়, হাসি, ঠাট্টা গান, লেগ পুলিং, কাঁধে হাত রাখা, লড়ে যাওয়া, জামা খুলে কোমর উঁচু ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে মাথার উপরের বি-ই-ই-শা-আ-আ-আ-ল প্লেনটার দিকে লাফিয়ে উঠি ওদের সাথে আমিও, ক্যাম্প ফায়ার আর নেচে উঠি আমিও - পচতে থাকা চারপাশ থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে নিয়ে !! লুজ কন্ট্রোল !! তো, এই বন্ধুরা আমার, এ দেশের কিস্যু হবে না বলা বন্ধুরাই আমার যদি শেষতক বলে ফেলে, আমরাই পাল্টে দিতে পারি এই দেশটাকে - পাল্টে দেবো, বিশ্বাস করতে সাধ হয় না!! বন্ধুত্বের চকোলেট সুঘ্রান থেকে যে ডাক উঠে এল - ভাবতেই পারছি না, এটা আদৌ কোনো সারমন, জ্ঞান বিতরন। এখানেই জিতে যায় রাঙ্গ দে বাসন্তি। রং দে বসন্তি থেকে রাঙ্গ দে বাসন্তি হয়ে ওঠে।
অথচ মিডিয়া আর প্রচারের ঢোলে দেশপ্রেমের দ্রিদিমকার। কেন রে বাপু? আমার বন্ধুটা একটা করাপ্ট লোকের জন্যে এনগেজমেন্টের মস্তির পরপরই ধড়াস্ মরে গেল। আমিও করাপ্ট লোকটাকে গুড়ুম মেরে দিলাম। এবার মরে গিয়েও লোকটা ভারতরত্ন-টত্ন বাগিয়ে ফেলবে দেখে খার খেয়ে রেডিও স্টেশনে গিয়ে - হ্যালো ! শুনছেন ! লোকটাকে কোনো উগ্রপন্থী নয়, আমরা মেরেছি, কয়েকজন ছাত্র, - এই গোটা ফাণ্ডায় দেশপ্রেম কোথায় হে? লোকটা ডিফেন্স মিনিস্টার এইটুকুতে? না ছবির সাথে ভগৎ সিং আর চন্দ্রশেখর আজাদ অঙ্গাঙ্গি সম্পৃক্ত বলে? অথচ এমনকি হয়তো বার খাওয়াও আছে। যে সিনেমার জন্যে শ্যুটিং করছিলুম, তার হিরোরা দুম দাম বন্দুক পিস্তল চালাতো, ফটাফট ইংরেজ মারত, যেন বার্ড ফ্লুয়ের মুরগি - কারন ইংরেজরাও মশা মারার মত নিগার সাফ করত। ঈগলের মুখোশ পরে অ্যাক্টো করে বার খেয়ে পাহাড় থেকে ঝপাং মেরে ওড়ার চেষ্টা কিংবা সুপারম্যান স্পাইডারম্যানেদে� � চরিত্রাভিনেতারা যদি বিল্ডিং বিল্ডিং এ লাফিয়ে বেড়ায় সেইরকম খানিকটা - কিন্তু আমার সোনার ইন্ডিয়া আমি হৃদয় খুলে লাভ ইউ - এই ফাণ্ডা কি করে জাগল? আদৌ, জাগে নি, এবং যাঁরা এটিকে দেশপ্রেম শিক্ষার বাইবেল প্রচারে বিকোচ্ছেন, তাঁদের ভালো হোক।
তবে যে প্রচারে ইংরিজি লেজ - Generation Awakens ? আজ্ঞে সচেতন হওয়ার ডাক - ভাবার ডাক, জাগার ডাক = দেশপ্রেম এ সমীকরণ কে সি নাগ মানবেন না। শুভঙ্কর মানতে পারেন। স্বদেশে শাহরুক খান যে অনুভূতির জন্ম দেন গ্রামীণ মানুষে বোঝাই ট্রেনে, নৌকায়, যাত্রাপথে, ২৫ পয়সায় জল বিক্রেতা ছেলেটিকে দেখে, দেখিয়ে, কার্গিল থেকে বিবেকানন্দ আশ্রম পর্যন্ত আমার দেশের প্রতি তেমন কোনো আঁকুপাঁকু আমির খানেরা জাগান নি। এ ছবির সারমন কেবল :- হয় চুপচাপ মেনে নিতে নিতে ছোট হতে হতে নিজেকে ঘেন্না করতে করতে বেঁচে থাক দিনান্তে, নইলে দায়িত্ব নাও করতলে, ধুনুচিহেন, যা যা ভালো লাগছে না, সহ্য হচ্ছে না পাল্টে দাও। নিজের ঘরে ময়লা জমলে নিজেকে সাফ করতে হয়, ঘরে মশা ঢুকলে নিজেকে তাড়াতে হয়, নয়তো কামড় খেতে হয়। দেড় ঘন্টা ধরে যে বন্ধুত্বের জন্ম দেন পরিচালক তা এইকথাটা কাঁধে হাত রেখে বলার জন্যে, কানের কাছে এসে ভনিতাহীন বলার জন্যে এবং আশ্চর্য নয় - বারবার দাগিয়ে দাগিয়ে বলার জন্য।
কিছু জিনিসে লোকের মায়া পড়ে যায়। যেমন - খেটেখুটে ফ্রীডম ফাইটের সীন লিখলুম ছাড়বো কেন? তাই গোটা সেপিয়া ফিলিম আপনাকে দেখতেই হবে হলে বসে - তার বেশ কিছু দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি সহ, তার ডায়লোগ প্র্যাকটিশ সহ - এখানে ওখানে টুকরো-টাকরা গুঁজে গুঁজে (নইলে বলবেন - ই কি আদেখলামো স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখানোর!) আর ফিলিম উইদিন ফিলিমের হিন্দি সংজ্ঞা আবিষ্কারে পুলকিত সমালোচনা লিখতে গিয়েই হুলাহুলা উল্লম্ফন। অ্যায়সশালা !! কিচ্ছু করার নাই কারণ আগেই বলেছি যে গল্পটা, সেটা বলে ফেলতে আধঘন্টা লাগে। বন্ধুত্ব সেলাই করতে দেড়ঘন্টা। তবে বাকি এক ঘন্টা?? চালাও পানসি ভগৎ সিং।
কলেজের ছেলেপুলেদের মস্তি ঠিকঠাক দেখানো হয়েছে; হিলিয়াম ভরা বেলুনের মত হাল্কা জীবনের পিছনেও কিছু লোকের অন্তত এখনো আধার আছে এ দেশে - যে দেশে ঠিকঠাক গর্জন করে বন্দেমাতরম বলতে গেলেও কাপড়ে-চোপড়ে কেস - সৎ; পাড়ায় আগুন লেগেছে দেখে জাগো, ঘরে আগুন লাগার অপেক্ষা না করে - প্রাচীন বাণী,তবু মনে করাবার; বিদেশি মেয়েটি আর তার ইংরেজ জেলর ঠাকুর্দার ডায়রি - বেশ পরিচ্ছন্ন; অ্যাক্টো - ফাসকেলাস, গান মিউজিক - আল্টি; বাদবাকি সবই বেশ, এমনকি এটাও মনে করাবার, শুরুতে যে আণ্ডারলাইন করে করে মানে বোঝানোর অ্যাটিচুডের কথা বলছিলাম, মূল নীতিবাক্য গুলো বাদ দিলে বিন্দাস জীবনের কোলাজ সাজাচ্ছেন যখন, প্রায় অভ্যেসেই আক্স এর পরিচালক বেড়িয়ে আসেন ভারি জোব্বার আড়াল থেকে, টুকিটাকি ম্যাজিক যেন প্রায় হাত ফসকেই উপছে আসে স্ক্রীনে - অনুপম খের মোবাইলের LCD মুছে নেন আলগোছে, চলে যেতে থাকা ছেলের দিকে তাকিয়ে; পিতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধোক্তি উচ্চারণ করা ভগৎ সিং দাড়ি খুলতে বসে হঠাৎ আসা dad -এর ফোন কল কেটে দেয়; -- আরো আছে, তবে সবাই যখন অন্তত একবার দেখবেই আমি খামোকা হাত ব্যথা করি কেন?
আর ইয়ে, লাল রং টা রক্তের।
ভবিষ্যতের ডানা থেকে খসে পড়া দু-একটা পালক কখনো কখনো বর্তমানের মায়াবী আলো-বাস্তবতায় ভাসতে ভাসতে অতীতে গিয়ে ল্যাণ্ড করে। ধুলোরোদ আর আবছায়ার মারাত্মক কম্বিনেশন থেকে তাকে চিনে নেওয়ার মতো রুস্তম মার্কেটে এখনো খুব একটা নেই। পুজোপ্যাণ্ডেলের নিয়ন-পাটাতনে ঝিনচ্যাক ছেলেমেয়েগুলো যখন ঘ্যামসে জানিয়ে দিচ্ছিল - ""নবনগর থেকে এসেছেন বিপুল প্রামানিক। আপনি হারিয়ে গেছেন। আপনার বাড়ির লোক আপনার জন্য ....'' তখন লাইনে দাঁড়ানো না-দাঁড়ানো ঝারিপ্রবণ তাবৎ বিস্ময়কুৎকুৎ বাঙালী পাব্লিকের গ্রে-ম্যটারে শুড়শুড়ি লেগেছিল কি?
রায়না কাঁটাপাড়া থেকে আসা বিশু মণ্ডল, মাকন্দা রামনাথপুর থেকে আসা রাজীব নস্কর, শালতমালীর জাহানারা খাতুন, আমতলার বিষ্ণুপদ রুঁই, কুচিন্দার সুশীল মাহাতো, ন্যাবাপোঁতার হারুন ইসলাম আপনি হারিয়ে গেছেন। আপনারা হারিয়ে গেছেন। কলকাতায় প্রতিমা দেখতে এসে, কলকাতার প্রতিমা দেখতে এসে আপনারা হারিয়ে গেছেন। ফিরে আসুন। আমাদের অনুসন্ধান কেন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়ান। আপনার বাড়ির লোক আপনাকে খুঁজছে। আপনার আট বছরের মেয়ে আপনাকে খুঁজছে। আপনার কপাল-জোড়া-লাল-সিঁদুর-টিপ-বউ আপনাকে খুঁজছে। আপনার বৃদ্ধ বাবা, শিরা-দড়ি-বটবৃক্ষ লোলচর্ম বাবা আপনাকে খুঁজছে। আপনার গ্রাম, ক্ষেত, পুকুর, ধার-কর্জ অস্তিত্ব, কপিলা গাই, ভাঙা মন্দিরের থান, তুলসীতলা, কুয়োশীতল গভীরতা, হিমশিউলি মাটিঘ্রাণ আপনাকে খুঁজছে। আপনি নিজেকে খুঁজে পেলে আমাদের হ্যালোজেন চমক-এ, আমাদের নিরুদ্বিগ্ন নিঃসংকট বেঁচে থাকায় ফিরে আসুন। আমাদের মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ান। এক একটা মানুষের হারিয়ে যাওয়ার চাপ এই সাজানো মণ্ডপ এই পাউডার-চিকণ জনস্রোতের সাবলীল নিশ্চিন্তার বুকে হাটু গেঁড়ে বসে; মাথা চাপড়ায়, হাহাকার করে। আমাদের অস্বস্তি হয়। সমস্ত ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাস ঝড় হতে থাকে, প্রতিটি চোখের জল - বৃষ্টি। কলকাতা ভেসে যেতে থাকে।
ইতিহাস ঘটনাকে মনে রাখে, স্বর্নমুকুটের আভিজাত্য না থাকলে - নাম নয়। চড়তে থাকা স্কাইস্ক্র্যাপার-কলার, টয়োটা-ফারারী গতি, উড়ালপুলের চাউমিন জট-এ সাজতে থাকা কলকাতা; লাল-নীল-সবুজ আলোয় আলোয় চাম্পি ক্যাটওয়াক ছ্যাঁকা সাঁটিস-ফিগার কলকাতাও নাম ভুলে যায়। টালি-দরমার চা-দোকানের আধবুড়ো পিন্টুদা, গরম কয়লার ইস্ত্রি চালানো সোনামাসি আর তার মেয়েটা - চিংকি, জঙ্গল পরিষ্কার করতে আসা হারুকাকা, নারকেল-সুপুরী পাড়তে আসা আসলাম চাচা - তোমরা কোথায়? সাড়া দাও! তোমরা হারিয়ে গেছ! শিগ্গিরি আমাদের অনুসন্ধান কেন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়াও! গ্লোবালাইজেশনের বাপের জন্মের কলকাতা হাতছুঁয়ে তোমাদের দেখতে না পেয়ে থমলাগা ইতি-চাউনিতে ঐ দ্যাখো রাজপথে ভোমলা মেরে গেছে। আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের বেঁচে থাকা, আমাদের অতীতবোধ - স্মৃতিসুগন্ধে মাড়িয়ে যে নির্মমতায় তোমরা জাস্ট "নেই' হয়ে যাচ্ছ তাতে, মাইরি, লোম-টোম শিউরে উঠছে।
এই যে দুর্গাপুজোর আলো-প্যাণ্ডেল খুলে নিচ্ছে আর পাঁচদিনের হুড়ুমতাল মস্তির গাড়ি হাড়হিম নৈঃশব্দে ডিমি ডিমি আন্ধেরায় গ্যারেজ হচ্ছে, এর পিছনে কোনো আলেয়া-সংকেত নেই কে বলবে? কুকুর-বেড়াল-গোরু-কাক-চড়াই-হকার তাড়িয়ে ভিতহীন যে ক্যন্টিলিভার টেকনোলজীতে কলকাতার স্বপ্নপুরীর হামলাবোল, তার ঠিক নিচেই শ্মশান। রাত বাড়লে আদুলগা বাংলাখোর মাতাল জমাদারদের খিস্তিবিচিন্তায় জঞ্জালপোড়ানো আলো জ্বলে উঠলে উপরের নিয়নসাম্রাজ্য ফ্যাকাশে দেখায়। দামী কাঠের আসবাবে উইয়ের অবধারিত ঔদ্ধত্যের মতো ছড়িয়ে থাকা অন্ধগলি থেকে সস্তার রঙ ঠোঁটে মেখে কলকাতার রাস্তায় রোগারোগা কালো মেয়েগুলো বেড়িয়ে আসে, দিনভর চামড়া চমকানো ঐশ্বর্যের পোর্সেলিন বডির গায়ে পান-গুটখার লালচে ছ্যাপ ফেলে। কলকাতার বেলেল্লা থাইয়ের পিছনে ভাঙা মোটরগাড়ির স্প্রিংওঠা সীটে বা ঝিঁঝিডাকা হাফ-চাঁদের নিচে আনকা কোনো গাছটাছের আবডালে পেঁচা কি শিয়াল সাক্ষী রেখে শিবের পেসাদীর দম ধরে। দেয়াল ঘেঁষে ছন্ছন্ করে দুর্গন্ধের ধারাজল জমতে থাকে।
সাঁই-চক্চক্ বড়লোকের কলকাতার পিছনে তাই আধপেটা লালচোখ আর এক ভুতুড়ে কলকাতা যে গুঁড়ি মেরে বসে নেই, কে বলবে? নাহলে এই যে প্রতিদিন কলকাতা থেকে, কলকাতায় এসে এত এত মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে - এরা কোথায় যাচ্ছে? দিনে দুবার ক্লীন শেভ মুখের ভিড়ে আধপাকা খোঁচাখোঁচা দাড়িওলা ঈষৎ পাগলাটে এইমাত্র-ছিল চোখগুলো এখন কোথায়? দড়িবেড়িয়ার থেকে এসেছেন সুজন হাঁড়ি, লাঠিপুকুর থেকে এসেছেন শেহনাজ চৌধুরি, খড়িশপুকুরের বাঁকে রায়, কামলা চকচাটুরিয়ার লক্ষ্মী হাইত, মিলনবৈষ্ণবপুরের নিতাই গোঁসাই। আপনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনাদের পাওয়া যাচ্ছে না। আপনারা পরিবারের লোকজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। আমাদের এগিয়ে চলার গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারেন নি, পিছিয়ে পড়েছেন। হারিয়ে গিয়েছেন। আপনারা আমাদের অনুসন্ধান কেন্দ্রের সামনে চলে আসুন। যদি না খেতে পেয়ে বা দ্রুতগামী হাইওয়ে ট্রাকের তলায় বা জমি বন্ধক রেখে গলার কলসী বেঁধে গঙ্গায় হারিয়ে গিয়ে থাকেন তো আপনাদের শরীর, সনাক্তকরণ চিহ্নসহ আমাদের মঞ্চের সামনে এনে হাজির করুন। এই ঝলমলে উৎসব-দিনে, শিল্পনগরীর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাঝে হুট্ করে গায়েব হয়ে যাবেন না। আমাদের ভয় লাগে। আমাদের হাত-পা হিম হয়ে আসে। পাঁজরা বের করে চিৎ হয়ে শুয়ে মুহুর্মুহু হাঁপের টানে কোটর-থেকে-বেড়িয়ে-আসব-আসব-চোখ নিয়ে কোনো অচেনা কলকাতার অশরীরী হাঁ মুখে তোমরা ঢুকে যাচ্ছ না তো? হেই মিলনচাচা! দিলীপ জেঠু! কুমুদকাকী! সাড়া দাও। এইখানে আলোর সামনে এসে দাঁড়াও। আমাদের বেঁচে থাকার ভয় তোমাদের খুঁজছে। আমাদের প্রতিদিনের দৌড়ে যাওয়া গতি তোমাদের খুঁজছে। আমাদের অনিশ্চিত অসহায়তা তোমাদের খুঁজছে।
(অবশ্য সকলেরই জানা আছে যে, দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী এসেছেন এমত মিথ ছড়িয়ে সাইকোলজিক্যালি পূজামণ্ডপে ভিড় বাড়াতেও সব অনুসন্ধান কেন্দ্রেই এসব ঘোষণা করা হয়। তাই সর্বজান্তা বাঙালীর কর্ণেন্দ্রিয়ে হেভি সেজেগুজে বেড়ানো ঘ্যামচ্যাক মেয়েদের হাসি ছাড়া বিশেষ কিছুই এসব দিনে ঢোকেনা। সুতরাং , প্রথম প্যারাগ্রাফে যা বলে দেওয়া হয়েছে সেসব ফালতু রিপীট করার কোনো মানেই হয় না।)
এ এক্কেবারে নতুন জিনিস হয়তো নয়, একটু তবু নতুনই বটে। অন্তত: আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এরকমটা কেউ ভাবেনি। বা হয়তো ভেবেছে, জানতে পারেনি কেউ, ফলে বাজারে বিক্রি হয়নি, ইয়েস, যেটা নিয়ে আজ কথা বলতে চলেছি - মশা মারার র্যাকেট। দেখেছেন নিশ্চয়ই। আলবাৎ দেখেছেন। ব্যাডমিন্টন র্যাকেটের মতন দেখতে, শুধু একটা নাইলন স্ট্রিং লেয়ারের বদলে তিনটে মেটাল তারের লেয়ার থাকে। চার্জ দিয়ে রাখতে হয়। তারপর প্লাগ থেকে খুলে সুইচ অন করে, মশাকে ফেদার কর্ক ভেবে লাগাও ব্যাকহ্যাণ্ড ফোরহ্যাণ্ড স্ট্রোক। মশার বডি, মেটাল তার স্পর্শ করলেই স্পার্ক। প্রথমে পিট্পিট্ করে, তারপর তারে আটকে যাওয়া মশাটার থেকে - একটু কাছ থেকে দেখলে ভালো বোঝা যায় - খানিক ধোঁয়া বেরোয়। তারপর ফট্ করে জোরে আওয়াজ হয়, আলোসহ। এই সময় পোড়া গন্ধটা পাওয়া যায় মশাটার থেকে। সারা ঘরে গন্ধ হয়ে যায়। আড়াই হাজার ভোল্ট কারেন্ট মশাটার গায়ে ঢুকে গেছে, তাই, মশাটা মারা যায়। অবভিয়াসলি, এবং সন্দেহাতীত ভাবে। খানিকক্ষণ এই রকম ভাবে মশা মারতে থাকলে র্যাকেটের গায়ে লেগে থাকতে দেখা যায় অনেকগুলো মশার আধপোড়া দেহ। তখন র্যাকেটটা ঝেড়ে ফেলতে হয়, নতুবা দেখতে খারাপ লাগে। অ্যাস্থেটিক্স। নতুবা কেমন লাগত মশার শবদেহ ভর্তি র্যাকেট নিয়ে আরো আরো মশার দিকে ছুটে যাওয়া? গা গুলোতো? খুনী খুনী লাগত নিজেকে? হা:।
আমি আর আমার ক্লাস ফোরের বোন সন্ধ্যে হলেই মশা মারতে নেমে পড়ি। তখন পাশের বাড়ির বনিও। বনি ক্লাস ফাইভ। ফার্স্ট হয়। পাশাপাশি দুই বাড়িতে শুধু চট্ পট্ ফট্ ফট্ মশার মৃত্যুধ্বনি ও শিশু-কলরব, হর্ষধ্বনি। যখন কিনছিলাম, দোকানি তখনই বলেছিল - "মরবে, মরবে। ফট্ ফট্ করে ফাটবে মশাগুলো, দেখতেই পাবেন।' তবে, দুটো পা দুদিকের তারে আটকে আড়াই হাজার ভোল্টে কালো হতে হতে একটা মশার অঙ্গার হয়ে যাওয়া আমি একদৃষ্টে দেখেছি। তার পুড়তে থাকা দেহের থেকে বেরোনো পোড়া গন্ধ আমার ঘর ভরে ছিল, লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ার মুহুর্ত থেকে ঘুম এসে যাওয়া পর্যন্ত গন্ধটা আমার ঘিরে ছিল। দিদিমা মারা যাওয়ার পরে শৈশবে একবার মাত্র শ্মশানে গিয়েছিলাম। পোড়া শবদেহ ঘ্রানস্মৃতি আমার চেতনে নেই, এ সময়ের থাকা উচিত। আছে কিনা নিশ্চিত নই।
মশাদের বাসাংসি জীর্ণানীর জন্যে এ এক ইলেকট্রিক চুল্লী, যার দরজা খোলা, আর যার প্রবেশমূল্য মনুষ্যোচিত ডেথ সার্টিফিকেট নয়, ওড়ার স্বাধীনতা। তবে আরো একটা ঘটনা আমায় দেখতে হয়েছে। স্তম্ভিত হয়েছি। যে সব মশাকে তারের জালে আটকানো যায়নি, প্রবল ইলেকট্রিক শক খেয়ে যারা ছিটকে পড়েছে মাটিতে, ভেবেছি মরে গেছে, র্যাকেটের গায়ে পুড়তে থাকা দেহাবশেষ ঝেড়ে ফেলার পরে যাদেরকে আর আলাদা করে বোঝা সম্ভব ছিল না মৃতদেহ থেকে, তারা খানিক পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ছটফট করতে থেকেছে, গোল হয়ে তীব্রবেগে ঘুরতে থেকেছে মাটির উপরে। যন্ত্রণায়? ওরা কি আর্তনাদ করে? দেখতে থাকি, দেখতে থাকি। একসময় তারা উড়ে যায়। আর মশা মারতে মারতে, পোড়া গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কিছু লহমা পরে আমি আবিষ্কার করি অনবরত বোঁ বোঁ শব্দ। চারপাশে অবাক তাকিয়ে - অদ্ভুত! শয়ে শয়ে মশা! ভয় পেয়েছি, কারণ একটা মাত্র র্যাকেট দিয়ে ওদের সামলানো যাচ্ছিল না। র্যাকেটের চার্জ কমে এসেছিল কিংবা ওরা মরছিল না কিংবা দুটো মরছিল আর ওরা দশটা আসছিল, যাই হোক, আমি ভয় পেয়েছিলাম। মশারীর ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম, আর বাইরে অনেকক্ষণ বোঁ বোঁ শব্দ শুনেছিলাম লাইট নিভিয়ে দেওয়ার পরেও, আর তখনো ঘরে মশাপোড়া গন্ধ, তীব্র।
যাঁরা ভাবছেন আমি কোনো প্রান্তিক অপ্রয়োজনীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষমতাশীর্ষ বর্গের শেষ বিধান ও তার বিপ্রতীপে গণ-অভ্যুত্থানের রূপকথা লিখতে চাইছি, তাদেরকে চুক্কি দিতে এবার আমরা বাজারের দিকে এগোবো, যেখান থেকে আমি মুরগি কিনি। এখানে, বারাসতে, মুরগি কাটার আগে ঘাড়ে একটা লুকোনো মোচড় দিয়ে ওটাকে একটা লম্বা প্লাস্টিকের ড্রামে ফেলে রাখা হয়, যতক্ষণ না ওর ছট্ফটানি বন্ধ হচ্ছে। তারপরে ছালটা, পালকসহ, ছাড়িয়ে নেওয়া হয়, যেমন ফল থেকে খোসা। ওর সমস্ত হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর, মৃত্যুমুহুর্তের আকুলিবিকুলি চোখের আড়ালে থাকে। শুধু শব্দটা শোনা যায়, খবরের কাগজে হেডলাইন পড়ার মত। অ্যাস্থেটিকস। বরোদায় ফতেগঞ্জ থেকে কিনতাম। ছেলেটা বিড়বিড় করে কিছু বলে ছুরিটা দিয়ে মুরগিটার গলা চিরে দিয়ে ওটাকে দু-পায়ের নিচে চেপে রাখত। গলা থেকে বেরোনো রক্ত গড়িয়ে যেত ওর পায়ের সামনে দিয়ে। এইভাবে একবার একটা মুরগির পায়ের হাড় ভেঙে গেছিল। টুঁটি ছিঁড়ে যাবার পরে তার আর্ত পা ছোঁড়াছুড়ি, ছেলেটার পায়ের নিচে পিষে যেতে যেতে হাড়টা ভেঙে দিয়ে গেছিলো। লেগপীসটা কাটার পরে দেখা গেছিল রক্ত বেরোচ্ছে মাংসের নীচে থেকে। আমার দাবি এভাবেই মুরগি কাটা উচিত। চোখের সামনে। বাড়িতে এনে রাঁধার আগে, স্যালাড সাজিয়ে খাওয়ার আগে জানা উচিত যাকে খাচ্ছি, তার শেষ সময়টাও। বোনকে নিয়ে এবার থেকে বাজারে যাব। ছোট্ট থেকে ও দেখতে পাবে কিভাবে মরে যেতে হয়। কাৎরাতে থাকা, ছটফট করতে থাকা মুরগিটাকে দেখতে ওরও ভালো লাগবে নিশচয়ই। পুড়তে থাকা মশাগুলোর দিকে তো একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দেখি। লাফিয়ে লাফিয়ে প্রতিদিন চলে আসে উৎসাহে - "মশা মারব মশা মারব' করে। খুব এনজয় করবে। তারপর পাঁঠার দোকানে। দেখেছেন কিভাবে ওদের কাটা হয়? আমি একবার বলি দেখেছিলাম। এক কোপে মুন্ডুটা নামিয়ে দেওয়ার পরে পিচকিরির মত রক্তস্রোত, আর কবন্ধ দেহটা লাফাচ্ছিল উঠোনে। ফ্যাসিনেটিং মাইরি। গোরু কাটা দেখেছেন? মানুষ? মানুষ মারলে কিরকম দেখায়? গণপিটুনি দেখেন নি? এ সময়-এর তো তবু কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে। আমরা শুধু টিভি আর খবরের কাগজ। পেটে ভোজালি ঢুকিয়ে কিভাবে উপরে এনে বাঁকিয়ে দিতে হয়, যাকে বলে "এল্' আর নাড়ি ভুঁড়ি বেরিয়ে আসে, কিভাবে সাঁড়াশি দিয়ে নখ উপড়ে ফেলতে হয়, চোখের ঠিক মনিতে ঢুকিয়ে দিতে হয় সরু করে কাটা পেনসিল, ব্লেড দিয়ে সূক্ষ্ম চিরে ফেলতে হয় মুখের চামড়া যাতে মাংসের নিচে থেকে হাড় বেরিয়ে আসে, তীব্র লাথি মারতে হয় বা একটা ভারি ডাণ্ডা দুহাতে তুলে নামিয়ে আনতে হয় জোরে দুই উরুর মাঝখানে - আমরা তো দেখিনি, আমরা তো জানিনা, অনুভব করিনা, আমরা শুধু খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেল, কখনো কখনো খুব ডিপ্রেসিং খবর এলে যাতে পাতা উল্টে দেওয়া যায় বা চ্যানেল পাল্টানো যায় - মিরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার - ২। এবার আসছেন আমোদপুর বীরভুম থেকে অতনু বর্মণ - ক্ল্যপ ক্ল্যাপ ক্ল্যাপ।।
তাহলে লেখাটাকে অবশেষে এদিকে এনে ফেলা গেল, নাকি ও নিজেই আসতে চাইছিল এদিকে! ভায়োলেন্স। প্রতিমুহূর্তের নির্মম ভায়োলেন্স, নিষ্করুণ, অ্যাস্থেটিক্সে যার বিন্দুমাত্র ঝোঁক নেই। আর এ জিনিসটা পাতি মিশে আছে আমাদের প্রতিদিনকার যাপনে। ট্রাকের তলায় চাপা পড়া কুকুরটা রাস্তার ঠিক মাঝখানে তার বেরিয়ে আসা অনেকখানি অন্ত্র ছড়িয়ে, দুখানি দেহাংশের মধ্যে এক বিঘৎ কালো টায়ারছাপ পীচরাস্তা ব্যবধান নিয়ে শুয়ে থাকে, ছাদে মরে যাওয়া শালিখটার চোখ খুঁটে খেয়ে যায় লাল পিঁপড়ের লাইন, সদ্য জন্মানো বেড়ালছানা দুটোকে খেয়ে উঠোনে কিছুটা রক্তের দাগ রেখে চলে যায় হুলোটা। পাড়ার মাংসের দোকানে রোজ চোখের সামনে কাটা হয় ছাগল, মুরগি আর, প্রদর্শণী যেন, ঝুলতে থাকে তাদের ছাল ছাড়ানো দেহ। রাজাবাজারে অবশ্য গোরু ঝুলালে আপত্তি। মরে যাওয়া জীবটার সাইজের উপর নির্ভর করে আমাদের রিয়্যাকশন - অ্যাস্থেটিক্স? আমরা এখন অনেক সীজনড। সিনেমায় দেখছি পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে কপালে গুলি, মাথায় পুঁতে দেওয়া বড় লোহার পেরেক হাতুড়ির ঘায়ে, উল্টে যাওয়া স-আরোহী গাড়িটার জ্বলে ওঠা বিস্ফোরণে। আমাদের বিনোদনে ঢুকে অছে এই ভায়োলেন্স, হিট সিনেমায়, স্পোর্টস চ্যানেলে, রেসলিং শো-এ, নিউজ চ্যানেল -খবরের কাগজে। বোমায় ছিন্ন ভিন্ন দেহের ছবি দেখছি, গুলি লাগা শরীর, ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হয়নি তখনো, রক্তে ভেজা। ছবি দেখছি শব্দে গাঁথা দু-কলম তিন-কলমের খবরে - চার বছরের মেয়ে ধর্ষণ, পাঁচ বছর, দশ বছর, পঁচিশ, পয়তাল্লিশ, পঁয়ষট্টি - গণধর্ষণ, পাশের বাড়ির দাদা, কাকা, নিজের বাবা,পুলিশ, পার্টি ক্যাডার। খুন একা বাড়িতে, ফ্ল্যাটে, সন্তানকে, বাবা-মাকে, শাশুড়ি, গৃহবধুকে বালিশে মুখ গুঁজে, গ্যাস জ্বালিয়ে, কেরোসিনে পুড়িয়ে, দা দিয়ে কুপিয়ে, পুঁতে ফেলে'। আমরা সীজনড। ভায়োলেন্স আমাদের আর এফেক্ট করে না, যতক্ষণ চেনা ইমেজারি ছাড়িয়ে না এগিয়ে যাচ্ছে সে। আমরা নড়ে বসি তখনই, যখন মেরে ফেলার পরে ধর্ষন করা হয় মেয়েটির মৃতদেহকে। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের যৌন নির্যাতনের পর তাদের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খেয়ে ফেলে কেউ, সেপটিক ট্যাঙ্কে মুখ গুজরে বৃদ্ধা মেরে ফেলে শিশুটিকে, ড্রেনে কুয়োতলায় খোঁজ পাওয়া যায় চুড়ো হয়ে ওঠা কঙ্কালস্তুপ। ভায়োলেন্স অতিক্রম করে যায় সাধারণত্ব। সংখ্যার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। পাঁচশো লোককে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যদি গুরুত্ব না পায়, তাই সংখ্যা বেড়ে যায় আড়াই হাজার-এ। চোদ্দ-আঠারো নয় খুন ও মৃত্যুর কাউন্ট বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হয় তিনশো -চারশো আটশো-য়। তিন-চারটে ধর্ষন মিডিয়ায় আসতে আসতে ফুলে ওঠে একশো-দুশোয়। শিশুদের মরে যাওয়াটাই আর যথেষ্ট থাকে না, তাদের মৃতদেহ সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তার নিচে নিয়ে ফেলতে হয়। পার্টি ক্যাডার আর পুলিশের গুলিতে ক'টা গ্রামবাসীরা মরে গিয়ে কিসুই হেলদোল মচাতে পারে না, তাদের ট্রাকে বোঝাই হয়ে অন্যত্র চালান হতে হয়, নদী সমুদ্রে বয়ে হাঙর কামট বোঝাই করে ফেলতে হয়, চালানপথে লাশের ঢিবি উপছে পথে গড়িয়ে পড়ে যেতে হয় তাদের কাউকে কাউকে। হাসপাতালের ডাক্তারদের রাজনৈতিক রঙনির্ভর রোগীদের প্রতি দুর্ব্যবহার যথেষ্ট থাকে না, ক্ষতস্থানে অত্যাচার, মিথ্যে এক্স-রে ও ডায়গনিসিস - ভায়োলেন্স বাড়তে থাকে। আমরা সীজনড।, আমাদের নাড়াতে, আমাদের চোখে দুফোঁটা জল আনতে, আমাদের মুখ থেকে ঘৃণা, বিস্ময়, ধিক্কার বের করে আনতে বাস্তবকে, ছায়াবাস্তবকে, মিডিয়াকে রাজনীতিকে, সমবেদনাকে অনেক খাটতে হচ্ছে। কি আর করা যাবে। এখন তো, যেমন বললাম, এমনকি মশা মারার র্যাকেটও বেরিয়ে গেছে বাজারে। আড়াই হাজার ভোল্ট শরীরে বয়ে প্রাণীগুলোর দেহ ক্রমশ অঙ্গার হয়ে যাওয়া আমরা অবলীলায়, নির্বিকারে দেখছি। কোন দূর গ্রামে কিভাবে মানুষ মরেছে জেনে চেগে গিয়ে গণধিক্কারপত্রে সইসাবুদ করে দেব এতই সহজে? এসো রাজনীতি, এস গণমাধ্যম, এস গুজব, ভায়োলেন্সের ডোজ বাড়াও, প্লীজ, আমাকে চমকাও!!