আসল কথাটা হল - মার্কেটিং। কি ভাবে বেচবে? সহজ উপায় - সমস্ত বিজ্ঞাপণওলারাই কোনো না কোনো সময় ব্যবহার করে করেই সহজ করেছেন যদিও - একটা কিনলে আর একটা ফ্রী। মানে কলেজপ্রেম দেখতে এলে সাইকেল রেস ফ্রী, ইংরেজের সাথে চাষীদের মাথাফাটাফাটি দেখতে এলে ক্রিকেট ম্যাচ ফ্রী। এমনকি জ্যাকি চ্যন ও এই মাত্র "দি মিথ" ছবিতে মল্লিকা শেরাওয়াতকে টেনে হিঁচড়ে শেষতক আর্কিওলজিস্টের খোঁজাখুঁজির সঙ্গে রাজা রানী সেনাপতি আর ঘোড়া তীর তলোয়ার যুদ্ধ ফ্রীতে দিয়েছেন। রং দে বাসন্তি দেখতে গিয়েও - ২৬শে জানুয়ারি - ভগৎ সিং পেলাম মিনি মাগনা। পয়সা উসুল। মার সিটি। অ্যায়স্শালা।



বোঝাবুঝি, মানে বই লিখন, অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে তীব্র বিতণ্ডা - কে পাগল বলে বুঝিয়ে দে বুঝিয়ে দে, কে আঁতেল বলে অ্যাই! বোঝালি ক্যান্? কিন্তু সে বাওয়াল সাহিত্যের অক্ষরমালায় পরিপাটি সাজিয়ে রাখা হোক, মাছ কিনতে বাজারে গিয়ে কমলকুমার আওড়ালে দামড়া খিস্তি বেটে কানে মাখিয়ে দোবো, সে কি ভালো হবে? তো, ডিস্ট্রিবিউটারের নিমের পাঁচন মুখ দেখতে না চাইলে যুগের ঝকঝকে ফেস্টুন : অ্যাটাচ ইওর মানেবুক। বুদ্ধদেব বাবু পর্যন্ত উত্তরা তৈরি করে বেঁটে গার্ডসাহেবকে দিয়ে বলিয়ে রাখেন - আমাদের দেশে আসো, এখানে কেউ লম্বা নয়, আমরা সবাই বেঁটে। কোন স্বপ্ন কেন দেখছো বলে দিতে ভূতের সিনেমা মাত্র হাতের কাছে মজুত দিগগজ মনোবিদ। আর আজকের প্রতিটা মুহূর্তকে ইন্টারপ্রীট করতে দ্বারে বসি আছে সাদাকালো ইতিহাস ফিল্ম।

বাল্যে মানে বই কিনবে কিনা - স্বচয়েস। ফির, ইংলিশ টেক্সট ও মানে বই একত্রে। চাইলেও সে ফেভিকল জোড় খুলতা নেহি। কেউ বলুক দেখি, আমি লার্নিং ইংলিশ বাজারে পেয়েছি মানে বই ছাড়া! পর্ষদ এক্ষুনি দুহাত জিভ কেটে দেখিয়ে দেবে - হয়না। এখন আর অত ঝামালি নাই, বইয়ের মধ্যেই মানে বই লেখা হচ্ছে। তাতে আয়তন ফুলে ফেঁপে ধুমসো। বয়েই গেল। টিভি দেখা বাঙালী ব্যাপক খুশি। মাথা চুলকালেই চুল ঝরছে যখন, এমত কালো সময়ে এ তো আশির্বাদ। টিভি দেখে দেখে যারা চিন্তা-ভাবনা করবার প্রক্রিয়া ও প্রচেষ্টার পশ্চাতে দিবানিশি সপাটে ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ ঝেড়ে চলেছেন, এবং যে গ্রামদেশব্যপী গণ্ডারের তাচ্ছিল্য বিকিরনে টানা হয় আর্ট ও মাস ফিল্মের মার্জিন, সিনেমা বিকোতে চাইছেন তাদের কাছেই, যেহেতু গ্লোবালাইজড মানিমার্কেটের ক্ষেতে সব ধান তারাই ফলিয়ে রেখেছে - ইজারা নিয়েছে এ গ্রহের বাণিজ্যের। রং দে বসন্তি তাই আঙুল বোলানো মানে-বইয়ের চাষ করেছে। একটা সীন দেখিয়েই অনিবার্য পরের সীনটায় তার অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। তাবৎ ভারতীয় মোগাম্বের মতন গাম্বাট খুশিতে ডগোমগো - দ্যাখ দ্যাখ পুরোটা বুঝেছি। একি আক্স ? যেখানে বচ্চন আর বাজপেয়ী তুমুল সুররিয়ালের মধ্যে খেলা করেন - এই ভাসেন, এই হারিয়ে যান? এ হল আইনক্স জেনারেশনের ছবি - চোখে আঙুল গেঁদে দেখিয়ে দেওয়ার নাম বাবাজী। সুতরাং হল থেকে বেড়িয়ে বিন্দুমাত্র আঘাত না খাওয়া ইগো, কিছু করিতে হবে, আজি মরিতে হবে - গুনগুনিয়ে থমথমে বাইকে স্টার্ট দেয়, আর চুলে হাওয়া লাগলেই যেহেতু খুলে খুলে যায় মন, ভেতর থেকে ভুস করে টুকি মেরে যান এ . আর . রহমান - অ্যায়স্শালা।



প্রশংসা করতেই হবে যিনি স্ক্রিপ্ট লেখেন। ধুরন্ধর হাত। সত্যজিৎ রায় একবার সন্দেশে চিত্রনাট্য লেখা শেখাচ্ছিলেন। আজ ২০ শে ফেব্রুয়ারি। গল্পের প্রথম লাইনটা এরকম দিব্যি লিখতে পারেন কিন্তু এটা যদি চিত্রনাট্যের প্রথম লাইন করতে হয়? ঘাম ছুটে যাবে মশাই ক্যমেরা দিয়ে আজকের ডেট দেখাতে। আমদানী করতে হবে এমন কোনো ঘড়ি যার গায়ে তারিখ লেখা থাকে। কিংবা ক্যালেণ্ডারের ২০ তারিখে ক্যামেরা ফোকাস করে বাকি সংখ্যগুনো ফেড করে দিন। কিংবা এক দিনের ছোট ক্যালেণ্ডার গুনো আমদানী করে কাউকে দিয়ে পাতা উল্টে ২০ তে স্থির করুন। অথবা সকালের যে কাগজটা ছুঁড়ে দিয়ে গেল হকার, তার তারিখ লেখা লাইনটায় ক্যমেরা নিয়ে যান। এত্ত ঝক্কি। "রাম ভালো ছেলে" - লিখে ফেলা যত সহজ, সেটাকে ক্যমেরা দিয়ে প্রমাণ করতে আপনাকে খান তিন চার ঘটনার ক্যামেরালভ্য সীন লিখতে হবে, যাতে প্রমাণ হয়, "রাম ভালো ছেলে"। তেমনি গল্পকার তো লিখেই খালাস : ""যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি শুরু হল""। সেটাকে ব্যাকগ্রাউণ্ড ন্যারেশন ছাড়া ক্যমেরায় বোঝায় কার সাধ্যি। এ ধুমসো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় কাছা গুটিয়ে নেমেছেন আমাদের স্ক্রীপ্ট রাইটার। আগে ইতিহাস দেখালেন - সাদা কালোয় - স্বাধীন সংগ্রামীদের স্কুলপাঠ্য ইতিহাস। তাপ্পরে দেখালেন ঘটমান বর্তমান - প্রেজেন্ট টেন্স। অত:পর আবার ফ্ল্যাশব্যাকে সাদা কালো সেপিয়া রেফারেন্স। কান পাকড়ে বুঝিয়ে দোবো। চালাকি? এরে কয় ইতিহাসের পুনরাভিনয়। এর পাশেই মনে পড়ে, অকারণেই, হাম দিল দে চুকে সনম - এ ঐশ্বর্য রাই দু হাতের শিরা খচাৎ কেটে ডুবিয়ে দিলেন গেরস্তালি সুইমিং পুলে, এরপর ভেসে উঠবে ওয়ার্ডআর্টে লেখা "INTERVAL ". সুইমিং পুলে কেন? জল যখন লাল হয়ে যাচ্ছে আপনি ভাবলেন আর্ট করার গিমিক। এবার সিনেমা শেষে বাইকে স্টার্ট মেরে ই হঠাৎ মনে পড়ে গেল আর্রে! সেই যখন হাতের আঙুল সামান্য কেটে গেছে কি যায়নি, সলমনের সাথে ঐ জলেই না ডুবিয়ে ধরেছিল আঙুলটুকু? আর আপনি বোবা হয়ে যান। পুনর্বার অবিশ্রান্ত মনখারাপ চোখে ভর করে। যখন আঙুল থেকে খুলছে না বিয়ের আংটি, শক্ত হয়ে এঁটে গেছে বলে গুণ্ডাদের ডিসুম গুলি টুলি খেয়ে যাচ্ছিলেন অজয়, হাসপাতালে ঐশ্বর্যের চিকিৎসার টাকার জন্যে যখন সেই আংটিই অনায়াসে আঙুল থেকে বের করছেন, আবার পরছেন, অস্থির পায়চারি সঙ্গে - দেখছেন ঐশ্বর্য, আর নিজের মঙ্গলসূত্র খুলে দিচ্ছেন একবারও না রুখে, কোনো ফ্ল্যাশব্যাক সাহায্য করেনি আপনার স্মৃতিকে। মিঠুন সুস্মিতা সেনের দিকে তাকালে, চিংগারিতে, ক্যামেরা যেন দৃষ্টি হয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামে সুস্মিতার বুক থেকে পেটে, অপেক্ষা করে কখন আঙুল কচলানো থেমে সরে যাবে হাতদুটি আর পর্দা জুড়ে জেগে উঠবে অদাহ্য অসহ্য নাভিটি; অথচ মনে পড়ে প্রতিদ্বন্দী, ধৃতিমান মেয়েটিকে ঝারি মারছে বোঝাতে তার শরীরটুকু ইঞ্চি ইঞ্চি মাপার দরকার হয়না ক্যামেরার।

অর্থাৎ আমি একটা কৌশলের কথা বলছি, একটা পড়ার কায়দার কথা, রং দে বাসন্তী যার বিপ্রতীপে দাঁড়ায়। সূক্ষ্ম সাজেশনে দর্শকের মাথাকে কাজ করতে দিয়ে সেখান থেকে জায়মান বোধ, বোঝাবুঝির ফসলে মানসিক উৎকর্ষের গোলা ভরার কথা - রং দে বাসন্তি যাকে আর্ট ফিল্ম ফ্লপ হওয়ার সহজ আঁতেল ফরমূলা বলে বাতিল করে। তবে এই সিনেমার বর্ম কই? অস্ত্র কি? আর দশটা বাজার চলতি হিট ছবির থেকে নিজেকে আলাদা করার মন্ত্র কি? আমরা তার মানে ছবিটার ভিতরে ঢুকতে চলেছি। ড্রাইভ দিতে প্রস্তুত? দাও তবে লাফ! অ্যায়স্শালা।

!!! লুস কন্ট্রোল !!! লুস কন্ট্রোল !!!

ইইইইইয়াআআআআআআহ

!!! লুস কন্ট্রোল !!!

আপ্নি তো পাঠশালা মস্তি কি পাঠশালা

পায়ের পাতা বেয়ে, নখ বেয়ে রোম বেয়ে ছুটে আসছে কাঁপন, নাচ - Live Life, Don't analyze it . ইইয়েস্স । লুস কন্ট্রোল !!!

মানুষ গৌতম বুদ্ধ, মহম্মদের কথা শোনে না, কিন্তু মায়ের বারণ মানে, খ্রীষ্ট রামকৃষ্ণের কিতাববদ্ধ কচকচি উল্টোয় না, কিন্তু বান্ধবীর কটাক্ষে সিগারেট নিভিয়ে ফেলে। নানক কি জরাথ্রুষ্টের সারমন শোনার আগেই বন্ধুর কাঁধে হাত রাখে, দুজনে এগিয়ে হয়তো অন্ধ মানুষটাকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিয়েও আসে (ইয়ে, তাঁর সম্মতি নিয়েই)। অর্থাৎ যে সম্পর্কগুলো সে নিজে তৈরি করে, তাদের সে একটু বেশি গুরুত্ব দেয়। সে দিন গিয়াছে, যখন রুপুলী পর্দায় বীর দেশপ্রেমী হুঙ্কার দিল - আয় আমায় রক্ত দে, পাব্লিক ক® প্যথোস উছলে কোরাসে "নে, নে, নে।" আজ এই ২০০৬ সালে পর্দায় দাঁড়িয়ে লেকচার দিতে থাকুন, আমরা বেড়িয়ে দুটো সিগ্রেট টেনে, এক গ্লাস ঠাণ্ডা কিনে, ফাঁকে কাউন্টারের মেয়েটাকে ঝারি মেরে আসব। (এবং এই কথাটাও আমি কিছু হঠাৎ বললাম না, ছবিতে অনুপম খেরই বলছেন - "" sms জেনারেশন, দো লাইন এক্সট্রা কেয়া বোল দিয়া লেকচার লাগতা হ্যায়"" )অথচ রাঙ্গ দে বাসন্তি চামচে করে গুনে গুনে নীতিশিক্ষা গিলোচ্ছে আর দেশসুদ্ধু লোক গ্লবগ্লবিয়ে গিলেছে - কি ব্যাপার? ট্যান যাবার ব্যপার নাই। তরমুজের শাঁস এটাই, গোটা সিনেমার বটম লাইম একখানাই - "কোই ভি দেশ পারফেক্ট নেহি হোতা। উসে পারফেক্ট বানানা পড়তা হ্যয়। পুলিশমে ভর্তি হোঙ্গে, মিলিটারি জয়েন করেঙ্গে, IAS বনেঙ্গে, পলিটিক্স কা হিস্যা হোকে ইয়ে সিস্টেম কো বদল দেঙ্গে। ইয়ে দেশ বদলেগা। হাম বদলেঙ্গে ইসে।" তাও একবার নয়, দুবার রিপীট হয় এই ডায়লগগুচ্ছ, যেমন রিপীট হয় প্রভূত সীন, প্রভূত সেপিয়া সিন। এ দরকচা মারা পুরোনো জ্ঞানের নড়ি, ডবল দাড়ি পব্লিকে তবে গিলছে কেন? এই তো বুঝেছেন, এ প্রফেটের সাদা দাড়ি নি:সৃত বিড়বিড় নহে, আমার বন্ধুর স্বগতোক্তি। হ্যাঁ বন্ধুত্ব, তিন ঘন্টা ধরে যে রিলেশনটা তৈরি করল অন্ধকার ঘরে প্রত্যেকের সঙ্গে ওয়ান ইস টু ওয়ান - রাঙ্গ দে বাসন্তি - স্রেফ অনৈশ্বর বন্ধুত্ব।

কলেজ - আড্ডা - চ্যাংড়মো - বাওয়াল - মস্তি ইত্যাদি নিয়ে কম সিনেমা হয়নি হিন্দিতে। স্মার্টনেস তাদের অনেকেরই নির্ভুল তাবিজ। কিন্তু একটা সিনেমা জুড়ে চরিত্রগুলোর সাথে রিলেশন তৈরি করার ক্যালি কতখনি এর অগে দেখিয়েছে বলিউড? ধরা যাক "দিল চাহতা হ্যায়"। বন্ধু সংখ্যা মোটে তিন। তাদের বাওয়ালিও আবার ঘুরে ফিরে মহিলাগন্ধী। বন্ধুত্বের মধ্যেও চোখে পড়ে, বড় হয়ে দাঁড়ায় ইগো - বন্ধুত্বকে গ্রাস করে - আর বড়লোক বাপের ব্যাটাদের এলিট ফুর্তি দেখে মজা পাই আমি, হাসিও কখনো, কিন্তু ওদের আমার বন্ধু ভাবতে পারি কি ঠিকঠাক? "স্টাইল" তো আল্টি একটা কমেডি-থ্রিলারই হয়ে গেল - বন্ধু হবার জন্যে চরিত্রগুলোকে ভাঙলও না বিন্দুমাত্র। যুবা তিনজন আলাদা মানুষের গল্প, যাদের দুজন পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্বের সুতোটাই প্রায় অধরা, লীডার-অনুগামী যেন - বাকি তো প্রেম আর প্রেমের পরত পরত উন্মোচন। খুব চেষ্টা করেও মনে পড়ছে না আটজন ছেলেমেয়ের বন্ধুতা ফোকাস করতে করতে একটা সিনেমা তৈরি হয়েছে শেষ কবে।

আমি জীবনে দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে ছাড়া এই মাত্র একটা সিনেমা হলে নিজের পয়সা খরচ করে স্বেচ্ছায় দ্বিতীয়বার দেখলাম। নিজেই অবাক। হতে পারে এখন হাতে টাকা পয়সা আগের চেয়ে কিছু উদ্বৃত্ত, তবু দেখতে এই যে ইচ্ছেটা হল, এটা তো মিথ্যে নয়! প্রথমবার প্রোমো দেখা মন খুব সন্দিগ্ধ, প্রতিটা দৃশ্যপট বদলের আগেই ভেবে নিচ্ছে এর পরে কি হবে, মাথা কাজ করছে প্রতিটা ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল থেকে খুঁজে নিতে পরিচালকের চোখটুকু, আর কি আশ্চর্য রকম প্রেডিক্টেবল প্রতিটি দৃশ্য, ঘটনা, রিঅ্যাকশন অনিবার্য মিলে যায় (যখন মিগ বিমান দুর্ঘটনার অন্য অন্য খবর শুনে টিভি বন্ধ করে দেয় ছেলেপুলে বোর হয়ে, অথচ মোহন যোশীর মুখ টিভি পর্দায় ভেসে উঠে বলে দেয় গল্প এই দিকেই গড়াবে, ইত্যাদি আরো অনেক অনেক)। হল থেকে বেড়িয়ে পর্যন্ত মনে হয়নি আবার দেখব, অথচ একটা টান, জানিনা কেন ( " Live Life, Don't analyze it. " ) আবার নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল সেই হলে, কাঠের চেয়ারে এবার, যেমন রিইউনিয়নের দিন কলেজে ফিরে যাই, স্কুলের বন্ধুদের মেল করি বাড়ি ফেরার আগে - আসছিস তো? মাঠে? সেই আগের মতো আড্ডা দেবো অনেক রাত অবধি, মশারাও কাম্ড়াতে কামড়াতে ক্লান্ত হয়ে যাবে - আসবি তো? দ্বিতীয়বার দেখতে গিয়ে তাই একটু বেশিই জোরে হেসে ফেলি, আগেরবারের চেয়েও, কখনো কখনো।

কিভাবে বন্ধুত্বটা তৈরি হয়? চারজনের কোনো ব্যাকগ্রাউণ্ড দেখায় না সিনেমাটা। হয়তো হস্টেলবাসী। বাকি চারজনের দুজনের বাবা নেই, দেশের মাটিতে কুরবান। আর দুজনের বাবার সঙ্গে ছেলের ঝগড়া - বা বোঝেন না ছেলেকে। একজন ড্রয়ার থেকে মায়ের ছবি বের করে কখনো দেখে একঝলক, আরেকজন বাপ-দাদার কমিউনালিত্বে জেরবার। সোজা কথায় আটজনের কারোর পিছনেই কোনো স্ট্রং ঠেকনা নাই, যার পরিপূরক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বন্ধুসঙ্গে। দুজন স্নেহশীলা মায়ের সাথে সুখী - যে স্নেহের ভাগ পেয়ে বাকিরা ভিজতে চায় অক্লেশে, আর এই মানুষজন্মের সব টান সব বাঁধন এসে পড়ে বন্ধুত্ব- এই শব্দটায়, হাসি, ঠাট্টা গান, লেগ পুলিং, কাঁধে হাত রাখা, লড়ে যাওয়া, জামা খুলে কোমর উঁচু ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে মাথার উপরের বি-ই-ই-শা-আ-আ-আ-ল প্লেনটার দিকে লাফিয়ে উঠি ওদের সাথে আমিও, ক্যাম্প ফায়ার আর নেচে উঠি আমিও - পচতে থাকা চারপাশ থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে নিয়ে !! লুজ কন্ট্রোল !! তো, এই বন্ধুরা আমার, এ দেশের কিস্যু হবে না বলা বন্ধুরাই আমার যদি শেষতক বলে ফেলে, আমরাই পাল্টে দিতে পারি এই দেশটাকে - পাল্টে দেবো, বিশ্বাস করতে সাধ হয় না!! বন্ধুত্বের চকোলেট সুঘ্রান থেকে যে ডাক উঠে এল - ভাবতেই পারছি না, এটা আদৌ কোনো সারমন, জ্ঞান বিতরন। এখানেই জিতে যায় রাঙ্গ দে বাসন্তি। রং দে বসন্তি থেকে রাঙ্গ দে বাসন্তি হয়ে ওঠে।

অথচ মিডিয়া আর প্রচারের ঢোলে দেশপ্রেমের দ্রিদিমকার। কেন রে বাপু? আমার বন্ধুটা একটা করাপ্ট লোকের জন্যে এনগেজমেন্টের মস্তির পরপরই ধড়াস্ মরে গেল। আমিও করাপ্ট লোকটাকে গুড়ুম মেরে দিলাম। এবার মরে গিয়েও লোকটা ভারতরত্ন-টত্ন বাগিয়ে ফেলবে দেখে খার খেয়ে রেডিও স্টেশনে গিয়ে - হ্যালো ! শুনছেন ! লোকটাকে কোনো উগ্রপন্থী নয়, আমরা মেরেছি, কয়েকজন ছাত্র, - এই গোটা ফাণ্ডায় দেশপ্রেম কোথায় হে? লোকটা ডিফেন্স মিনিস্টার এইটুকুতে? না ছবির সাথে ভগৎ সিং আর চন্দ্রশেখর আজাদ অঙ্গাঙ্গি সম্পৃক্ত বলে? অথচ এমনকি হয়তো বার খাওয়াও আছে। যে সিনেমার জন্যে শ্যুটিং করছিলুম, তার হিরোরা দুম দাম বন্দুক পিস্তল চালাতো, ফটাফট ইংরেজ মারত, যেন বার্ড ফ্লুয়ের মুরগি - কারন ইংরেজরাও মশা মারার মত নিগার সাফ করত। ঈগলের মুখোশ পরে অ্যাক্টো করে বার খেয়ে পাহাড় থেকে ঝপাং মেরে ওড়ার চেষ্টা কিংবা সুপারম্যান স্পাইডারম্যানেদে� � চরিত্রাভিনেতারা যদি বিল্ডিং বিল্ডিং এ লাফিয়ে বেড়ায় সেইরকম খানিকটা - কিন্তু আমার সোনার ইন্ডিয়া আমি হৃদয় খুলে লাভ ইউ - এই ফাণ্ডা কি করে জাগল? আদৌ, জাগে নি, এবং যাঁরা এটিকে দেশপ্রেম শিক্ষার বাইবেল প্রচারে বিকোচ্ছেন, তাঁদের ভালো হোক।

তবে যে প্রচারে ইংরিজি লেজ - Generation Awakens ? আজ্ঞে সচেতন হওয়ার ডাক - ভাবার ডাক, জাগার ডাক = দেশপ্রেম এ সমীকরণ কে সি নাগ মানবেন না। শুভঙ্কর মানতে পারেন। স্বদেশে শাহরুক খান যে অনুভূতির জন্ম দেন গ্রামীণ মানুষে বোঝাই ট্রেনে, নৌকায়, যাত্রাপথে, ২৫ পয়সায় জল বিক্রেতা ছেলেটিকে দেখে, দেখিয়ে, কার্গিল থেকে বিবেকানন্দ আশ্রম পর্যন্ত আমার দেশের প্রতি তেমন কোনো আঁকুপাঁকু আমির খানেরা জাগান নি। এ ছবির সারমন কেবল :- হয় চুপচাপ মেনে নিতে নিতে ছোট হতে হতে নিজেকে ঘেন্না করতে করতে বেঁচে থাক দিনান্তে, নইলে দায়িত্ব নাও করতলে, ধুনুচিহেন, যা যা ভালো লাগছে না, সহ্য হচ্ছে না পাল্টে দাও। নিজের ঘরে ময়লা জমলে নিজেকে সাফ করতে হয়, ঘরে মশা ঢুকলে নিজেকে তাড়াতে হয়, নয়তো কামড় খেতে হয়। দেড় ঘন্টা ধরে যে বন্ধুত্বের জন্ম দেন পরিচালক তা এইকথাটা কাঁধে হাত রেখে বলার জন্যে, কানের কাছে এসে ভনিতাহীন বলার জন্যে এবং আশ্চর্য নয় - বারবার দাগিয়ে দাগিয়ে বলার জন্য।

কিছু জিনিসে লোকের মায়া পড়ে যায়। যেমন - খেটেখুটে ফ্রীডম ফাইটের সীন লিখলুম ছাড়বো কেন? তাই গোটা সেপিয়া ফিলিম আপনাকে দেখতেই হবে হলে বসে - তার বেশ কিছু দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি সহ, তার ডায়লোগ প্র্যাকটিশ সহ - এখানে ওখানে টুকরো-টাকরা গুঁজে গুঁজে (নইলে বলবেন - ই কি আদেখলামো স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখানোর!) আর ফিলিম উইদিন ফিলিমের হিন্দি সংজ্ঞা আবিষ্কারে পুলকিত সমালোচনা লিখতে গিয়েই হুলাহুলা উল্লম্ফন। অ্যায়সশালা !! কিচ্ছু করার নাই কারণ আগেই বলেছি যে গল্পটা, সেটা বলে ফেলতে আধঘন্টা লাগে। বন্ধুত্ব সেলাই করতে দেড়ঘন্টা। তবে বাকি এক ঘন্টা?? চালাও পানসি ভগৎ সিং।

কলেজের ছেলেপুলেদের মস্তি ঠিকঠাক দেখানো হয়েছে; হিলিয়াম ভরা বেলুনের মত হাল্কা জীবনের পিছনেও কিছু লোকের অন্তত এখনো আধার আছে এ দেশে - যে দেশে ঠিকঠাক গর্জন করে বন্দেমাতরম বলতে গেলেও কাপড়ে-চোপড়ে কেস - সৎ; পাড়ায় আগুন লেগেছে দেখে জাগো, ঘরে আগুন লাগার অপেক্ষা না করে - প্রাচীন বাণী,তবু মনে করাবার; বিদেশি মেয়েটি আর তার ইংরেজ জেলর ঠাকুর্দার ডায়রি - বেশ পরিচ্ছন্ন; অ্যাক্টো - ফাসকেলাস, গান মিউজিক - আল্টি; বাদবাকি সবই বেশ, এমনকি এটাও মনে করাবার, শুরুতে যে আণ্ডারলাইন করে করে মানে বোঝানোর অ্যাটিচুডের কথা বলছিলাম, মূল নীতিবাক্য গুলো বাদ দিলে বিন্দাস জীবনের কোলাজ সাজাচ্ছেন যখন, প্রায় অভ্যেসেই আক্স এর পরিচালক বেড়িয়ে আসেন ভারি জোব্বার আড়াল থেকে, টুকিটাকি ম্যাজিক যেন প্রায় হাত ফসকেই উপছে আসে স্ক্রীনে - অনুপম খের মোবাইলের LCD মুছে নেন আলগোছে, চলে যেতে থাকা ছেলের দিকে তাকিয়ে; পিতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধোক্তি উচ্চারণ করা ভগৎ সিং দাড়ি খুলতে বসে হঠাৎ আসা dad -এর ফোন কল কেটে দেয়; -- আরো আছে, তবে সবাই যখন অন্তত একবার দেখবেই আমি খামোকা হাত ব্যথা করি কেন?

আর ইয়ে, লাল রং টা রক্তের।