পুজোয় আজকাল খুব ভয়ে থাকি। টেনশন। কে কখন টেনে নিয়ে চলল ঠাকুর দেখতে। ব্যাস। গেল ঠিভি দেখার বারোটা বেজে। বেজায় সাবধানে থাকি।

বাকি বচ্ছরভর কোনো ঝামালি নাই। কোনো টানাহ্যাঁচড়া নাই। সকালে ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে টিভি খুলে বসে যাও, স্নান করে খেয়ে নিয়ে ঘুম পাওয়া অবধি ঘন্টা দুয়েক, আর সন্ধ্যে থেকে টানা রাতে খাবার আগে পর্যন্ত। সব ঠিকঠাক, কেবল পুজোর ক'টা দিনই সমস্যা। মন্ডপে গিয়ে ঠাকুর না দেখলেই লোকের প্রাণ আই`ঢাঁই করবে। কেন বাপু? টিভিতে কি ঠাকুর দেখায় না? বরং আরো ভালো করে দেখায়। প্রতিমামুখ ক্লোজ`আপ করে, প্যাণ্ডেলের ভিতরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, রাস্তায় আলো ঝকমক - এরচেয়ে ভালো আর কী দেখা যাবে গুচ্ছের ভিড় ঠেলেঠুলে? আরো সমস্যা, এই পুজোর চক্করে পড়ে রিয়েলিটি শো গুলো মিস হয়ে গেলে। ঘরে বসে অ্যাডের ফাঁকে কিছুক্ষণ পুজোপরিক্রমা দেখে নেওয়াই যায় কিন্তু কুচোকাঁচারা টানতে টানতে মন্ডপে নিয়ে গেলেই চিত্তির।

আসলে এত ভালো ভালো প্রোগ্রাম দেয় টিভিতে আজকাল। সিরিয়াল তো আর দেখাই হয় না। আগে হিন্দিগুলো দেখতাম, এখন তো বাংলা চ্যানেলগুলো ও ভরে গেছে রিয়েলিটি শো-এ। আমার তো দারুণ লাগে। এক্কেবারে বাস্তব ঘটনা সব দেখায়। সামনাসামনি। কোনো নকল নেই। স্ক্রিপ্ট করে, চিত্রনাট্য করে মেকি কান্না আর মিথ্যে অভিনয় নেই। সব একদম যেমনটি, তেমনই দেখা যায় টিভিতে। আজকাল বানানো জিনিস দেখতে মোটেই ভালো লাগে না। কেমন যেন ঠকাচ্ছে ঠকাচ্ছে মনে হয়। সেই 'এম টিভি বকরা' বা "ছুপা রুস্তম'এ যখন রাস্তার লোককে ধরে ধরে বোকা বানাতো, এত্ত মজা লাগত দেখতে। ওরা কেউ কক্ষনো ধরতেই পারত না ওদের টিভিতে দেখানো হচ্ছে। কি বোকা বোকা লোক সব রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় ভাবলেই হাসি পায়। প্রাণ ভরে হাসি আমি। তারপরে যখন কৌন বনেগা ক্রোড়পতি দেখাতো! কতবার চোখ বুজে ফেলেছি, বিড়বিড় করে ঠাকুর ঠাকুর ডেকেছি, যাতে লোকটা প্রশ্নটার ঠিক উত্তর দিয়ে দেয়। "ইট ইজ দ্যা রাইট আনসার' বলে উত্তরটা সবুজ হয়ে গেলে কি যে স্বস্তি হয়! দমচাপা উত্তেজনা শেষে একটা বড় শ্বাস ফেলি। সেই কবে থেকে মন দিয়ে দেখি ইন্ডিয়ান আইডল, সা রে গা মা পা। গেম শো আর রিয়েলিটি শো তো মিলে মিশে একাকারই হয়ে আছে। ফেম গুরুকুল, বিগ বস, নাচ বলিয়ে, ঝলক দিখলা যা - এর কোনোটাই ছাড়া যায়, বলুন? এলিমিনেশন রাউন্ডটা প্রচন্ড টাচি হয়। আমার মতো একটু সংবেদনশীল মন হলে আপনার চোখ জলে ভরে আসবেই। অতগুলো এপিসোড লড়ে আসার পর যখন একটা ছেলে বা মেয়ে চলে যায় তখন কেমন একটা আত্মীয়বিয়োগের ব্যথা হয়। প্রতিযোগীদের চোখে জল দেখলেই আমি আর থাকতে পারিনা। আমারও চোখ ভিজে আসে। সেদিন দেখাচ্ছিল কী গরীব ওরা, ধার শোধ করবে বলে ই এম আই খেলতে এসেছে। হেরে গেল। এখন ওদের কী হবে? মীরাক্কেল খেলতে আসার জন্যে যে ছেলেটার নাম কাটা গেছিল স্কুল থেকে? ওর কী হবে। এইজন্যেই চেয়েচিন্তে একটা মোবাইল নিয়েছি। প্রচুর এস এম এস করি তো আমি। কালকেই ই এম আই এর মেয়েটার জন্যে ৫০ টা এস এম এস করেছি। প্রচুর ফোন করি সারাদিন, টিভিতে দেওয়া ফোন নম্বরে। রোজগেরে গিন্নি, বেটা বেটির ব্যাটেল, মা vs বৌমা - যদি পার্টিসিপেট করা যায়।

দাদাগিরি, ড্যান্স বাংলা ড্যান্স, ই এম আই, ধুম মচা দে, সুকন্যা পাড়ায় পাড়ায়, ধা-এ ধামাল, কিচ্ছু বাদ দিই না। বুগী য়ুগী, ফিয়ার ফ্যাক্টর, এম টি ভি রোডিজ, রাখিকি স্বয়ংবর, খতরো কা খিলাড়ি প্রত্যেকটাই দেখতাম আর দেখি। কত মানুষের কথা জানা যায়। সেদিন যেমন দেখালো একটা মেয়ের ছোটোবেলায় এক ফুচকাওয়ালার সাথে প্রেম ছিল। বাবা জানতে পারায় ব্যাপারটায় ওখানেই চুকে যায়। সেই ফুচকাওয়ালাকে এত দিন পরে আবার খুঁজে এনে টিভিতে, মঞ্চে তোলা হল। ভাবুন! মানুষের জীবনেও কত পরিবর্তন আনতে পারে এই রিয়েলিটি শো। সেদিন আমি নিজেকে একদম সামলাতে পারিনি। চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে হাততালি দিয়ে উঠেছিলাম। ওরা সবাই পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছিল কি হয়েছে দেখতে। বললাম সব, কী অসাধারণ ব্যপার!

সাচ কা সামনা দেখতে দেখতে তো মাঝে মাঝে নিজের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়াই আমি। এই প্রশ্নের জবাব কী দিতাম আমি, সত্যি কথা বলতে পারতাম? আমি নিজেই কি জানি সত্যি কোনটা? যন্ত্র রাখা হয়েছে তো ঐ জন্যে। একেবারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জেনে বলে দেবে আমার জীবনের সত্যিগুলো, আমার অনুভূতি, ইচ্ছেগুলো। যেগুলো হয়তো আমার কাছেই এখনো পরিষ্কার নয়। ভাবতেই শিউরে উঠি। উঃ! এই দেখুন গায়ে পদ্মকাঁটা!

পুজো এলে তাই আমি একটু ভয়ে থাকি। সাবধানে থাকি। বেয়াক্কেলে ডাকে যেন কোনো রিয়ালিটি শো না মিস হয়ে যায়। ঐ অনুষ্ঠানগুলোই এখন প্রায় জীবন আমার। আরো নিয়মনিষ্ঠ হয়ে উঠি টিভি চালানোয়। সন্ধ্যেবেলার টিফিনটা নিজের ঘরে এনেই খাই, রোজগেরে গিন্নি দেখতে দেখতে। তাছাড়া বাইরে বেরোলেই ভয়। এই সেদিন তিন্নিদের বাড়িতে যা হল। ওরা ঠাকুমাকে বাড়ি দেখতে রেখে এক সপ্তাহের জন্যে ঘুরতে গেছিল পুজোর ছুটিতে। ফিরে এসে দরজা খুলে পেল বুড়ির পাঁচ দিনের পুরোনো লাশ। পঁচ ধরে গেছে। আমার শীত করে। আমি টিভির ভল্যুম বাড়িয়ে দিই। সৌরভকে দেখি ভালো করে। কি আত্মবিশ্বাস, কি সরল ভালোমানুষ ছেলেটা, গুগলির প্রশ্নগুলো মনে রাখতে চেষ্টা করি। ভীড়ে বেরিয়ে কি হবে! কালকেই শুনলাম রুষিরা কলেজ স্কোয়ারে ঠাকুর দেখতে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে পড়েছিল। কেউ প্রচন্ড জোরে ওর বুক মুচড়ে দিয়েছে। বাড়ি এসেও ফোঁপাচ্ছিল মেয়েটা, তেরো বছর বয়স, ফ্রক খুলতে তখনো নখের দাগে রক্ত জমে লাল দাগড়া হয়ে ছিল ওর বুক। আমি সরে আসি তাড়াতাড়ি। চ্যানেল ফিরিয়ে খুঁজে বের করি কোথায় প্রশ্নের উত্তর বললেই লাখ টাকা। কোন প্রতিযোগী ছোট্টোবেলা থেকে ফড়িঙের ডানা জমায় কাঁচের বয়ামে। রতনের শ্বশুড়মশাইয়ের মাইনের গোটা টাকাটাই সেদিন ছিনতাই হয়ে গেল। দুজন সতেরো আঠারো বয়সের ছেলে নাকি, মুখে রুমাল বেঁধে একটা বিশাল ছোরা হাতে ওকে একটা পাঁচিলের ধারে নিয়ে যায়। উনি বাধা দিয়েছিলেন বলে ওরা বুকের আড়াআড়ি হাত চালায়। ১২ টা স্টীচ পড়েছে ভদ্রলোকের। নাচ বাংলা নাচ কোন চ্যানেলে হচ্ছিল? আমি এত ভুলে যাচ্ছি আজকাল। চ্যানেল স্ক্যান করতে দিয়ে দিই। ধুস, সব জায়গায় অ্যাড। নিত্যদের বাড়ির সব সময়ের কাজের মেয়েটা কোন এক ড্রাইভারের সাথে ভুল করে। ও ভেবেছিল ভালোবাসা। ছেলেটা একটা ঘর ভাড়া করে পাঁচজন বন্ধুর সাথে এক সপ্তাহ ধরে সুমির সাথে জোর করে, তারপর পালিয়ে যায়। দেশে যাওয়ার নামে ছুটি নিয়ে এক সপ্তাহ পর সুমির খবর পাওয়া যায় হাসপাতাল থেকে। রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। আরো তিন দিন কোনোরকমে বেঁচে থেকে অবশেষে মেয়েটা মুক্তি পায়। ওর মা নাকি বেডের লোহায় মাথা ঠুঁকে ঠুকে কাঁদছিল। আমি ভালো করে দেখি নীলোৎপলের মায়ের কান্না। ছেলে ফাইনালে উঠে জাজেদের সিদ্ধান্তে ছিটকে যায় বলে মহিলা কাঁদছিলেন। নাঃ অতটা ফুঁপিয়ে নয়, সুমির মা নিশ্চয়ই হাহাকার করছিলো। চেঁচিয়ে অভিশাপ দিচ্ছিল ভগবানকে, অদৃষ্টকে।

খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি। টিভির নিউজ চ্যানেল ও দেখিনা পারতপক্ষে। কখনো চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে কোনোভাবে দু এক টুকরো খবর কানে ভেসে আসে যদি, এই ভয়ে মিউট করে চ্যানেল বদলাই। কোথায় টিফিন বাক্সে ভরা বোমা ফেটে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মরে গেল, কোথায় অ্যাকসিডেন্টে নদীতে পড়ে গেল গোটা বাস, রাষ্ট্রদূত অপহরণ, ভোটের আগে পরে খুন - এ খবর শুনে আমি কি করব? আমি মন দিয়ে দেখি রাহুলের সঙ্গীরা কি বলছে, বিগ বস-এ কে টিকে থাকবে শেষ পর্যন্ত? দুজন মেয়ে পার্টিসিপেন্ট দুজনের সম্বন্ধে কি বাজে ভাবে বলল। ওরা কেউ একে অন্যকে সহ্য করতে পারছে না, দর্শকরা কী বলবে ? আমি ঋতুকে ভোট দিই। যদি একটা এস এম এসে কাজ না হয়, দুটো ভোট দিই। সেলিব্রিটিদের গানের প্রতিযোগীতায় দর্শকরাই জাজ। এটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। নীলুদের বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট হচ্ছে। নীলুর মা কিছুতেই জমিটা ছাড়তেন না, কিন্তু কিছুদিন বাড়িতে লোক আসা আর ধমকানির পর রাতে ওরা দরজায় ঢিল মারতে শুরু করল। নীলুকে একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে দুজন মারধোর করল। কালীপুজোর আগেই ফ্ল্যাটটা হয়ে যাবে। কেমন লাগে কোনো বিধবার, রাতে নাবালক ছেলে নিয়ে শুয়ে থাকাকালীন ঘরের দরজায় জানলায় ইঁট পড়লে? টিনের সানশেডে পড়া আধলা ইঁটের শব্দে, সদর দরজায় কাচের বোতল ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে? পুকুরপাড়ে মিলনীর মাঠে রাতে নেশা করত পাড়ার পাঁচ ছটা ছেলে, মাসখানেক আগে তাদের একজন কে সাপে কামড়ায়। কাল অমিয়াদের বাড়ি যেতে হয়েছিল একটু, স্টেশন থেকে ফেরার পথে দেখলাম জল জমা মিলনীর অন্ধকার মাঠে আলো জ্বলা প্যান্ডেল, প্রতিমা আর প্লাস্টিকের চেয়ার গুলোকে সাক্ষী রেখে রাশি রাশি ব্যাং ডাকছে। অবিশ্রান্ত। একটাও লোক ছিলনা, শুধু ব্যাঙের ডাক। আমি ভাবছিলাম সেই সাপটা কি এখনো এই মাঠেই আছে? কোনো কোনায়? একসাথে এতগুলো ব্যাঙের ডাকে সে কি আনন্দ পাচ্ছে, নাকি ভয়? আমি তাড়াতাড়ি হাঁটা দিই। শালবাগান তিন নম্বরের প্যান্ডেলটা খুব সুন্দর হয়েছে। রংচঙে, চমকদার। অত রাত্রে ঐ জমকালো প্যান্ডেলের মধ্যে দুটো কালোকুষ্টি নোংরা মশারী টাঙিয়ে দুজন লোক শুয়ে আছে। ঢাকীরা বোধহয়। কয়েকলাখ টাকার পুজোর ঠাকুর বিসর্জনের পর একাদশীর সকালে ওরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঢাক বাজিয়ে বকশিসের জন্যে হাত পাতবে। কালো, শক্ত, শিরা ওঠা হাত, যার পাতায় কোনো ভাগ্যরেখা নেই। সেই হাতে, ছোঁয়া বাঁচিয়ে, একটা দশ টাকার নোট ফেলে দিয়ে আরেকটা দশটাকা না দেওয়ার কারন দেখিয়ে বরুণের বৌ কুড়ি মিনিট ঝগড়া করবে, গজগজ করবে। আমি তখন টিভির ভল্যুম বাড়িয়ে দেবো। দর্শকের, প্রতিযোগীর, জাজেদের একটাও কথা তখন মিস করা সম্ভব নয়। আমার দরজাটা ভিতর থেকে খুব আঁট করে বন্ধ করে রাখবো, যেমন রেখেছি পুজোর এই দিন ক'টা।