গতি ও জাড্যধর্ম
বাসে উঠলেও শোনা যাবে "পিছন দিকে এগিয়ে যান'।
ফ্লুরোসেন্ট হাইলাইট : "এগিয়ে'। সমকালে যে শব্দটিতে, অনিচ্ছাতেও, "অগ্রগতি'
আর "উন্নয়ন'-এর দিকে অবধার্য আঁকশিটান। আমরা কিন্তু আরো স্পেসিফিকালি,
ফোকাস করব অন্য একটি রিলেটেড অংশশব্দ : "গতি' তে। যে গতি, পথ ফুরোবার পরেও
জেগে থাকে, অনবধান অভ্যাসে। নিউটন "জাড্য' নাম দেন।
"গতি' টানলেই "বেগ' আসবে - "জোরে' না "আস্তে', সুতরাং কম্প্যারিজন, আর আমরা
এসে দাঁড়ালাম সভ্যতার ষষ্ঠ রিপুর সামনে। রেস ও র্যালিময় আমাদের মুহুর্তিক
বেঁচে থাকা, সুযোগ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে তুলনাবিম্বনে দেখে সুখসমীক্ষা, প্রকৃত
প্রস্তাবে, অগণন প্রতিদ্বন্দ্বী জন্ম দিয়ে চলে শুধু। কি মজার!
গর্ভযন্ত্রণাহীন এই প্রসববাহুল্যে ক্লান্তি নেই, বিচলন নেই, আদতে কুত্রাপি
সেই বোধটাই নেই!
নতুন রাস্তাঘাট হচ্ছে। যানজট কম। নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা অপরিণত। হাতে
স্টিয়ারিং। এসো গতি, এসো গতি, ঊর্ধ্বশ্বাসে এসো। রাজারহাট - সল্টলেক আই টি
পার্ক এলাকায় প্রায়ই অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে। অধিবেশনের সিদ্ধান্তে সরকারী
ট্রাফিক ব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষ থাকছে। অথচ, শেষপর্যন্ত, গ্রাউণ্ড
রিয়েলিটি, পথে পড়ে থাকছে প্রতিদিনের হেরে যাওয়া, ঘামে ভেজা, পিছিয়ে যাওয়ার
প্রতিশোধ - গতি। রোড রেজ - দৈনন্দিন পরাভব টুপিয়ে জমা অসন্তোষ, অপারঙ্গমতার
হতাশা, ব্যতিক্রমী সফল হয়ে উঠতে না পারার অসহায়তা, দ্বিধাগ্রস্ত সামাজিক
টানাপোড়েনের ক্রীড়নক-মুঠো কচলানো যন্ত্রণা, প্রতিবেশের জন্যে ঘৃণা আর
স্বশ্রদ্ধার বাড়াবাড়ির কিউমুলেটিভ ফলাফল।
একটা গাড়ি, যা কিনা মোটামুটি আপনার দ্বিতীয় সবচেয়ে দামী জিনিস, যা কিনা
আপনার স্টেটমেন্ট অফ সেল্ফ, দেখা যচ্ছে নিয়ম-নীতি-আইন-সামাজিকতার
বজ্রআঁটনমাঝে প্রায় একমাত্র মুক্তি, স্বাধীনতা বললে স্বাধীনতা। ভাড়াটে
গাড়ির ক্ষেত্রে হয়তো এমনকি পরস্মৈপদী রাজত্ব। ভার্চুয়াল ক্ষমতা আস্বাদ।
জীবনযাত্রার ভাগমভাগের সাথে রিলেট করে ইনোসেন্ট ছাড়পত্র - "আহা, গতিই জীবন
এখন' বলে মুখ লুকোবার উপায় নেই। ওভারটেক ঘনঘটা, প্রতিশোধধাক্কা, ফুটপাথে ও
রাজপথে পিষে দেওয়া হাত পা আর অঙ্গভঙ্গি-মুদ্রারাক্ষস প্রমাণ করছে, গাড়ি
চালাতে গেলেই চেনা লোকটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। শান্ত, সন্তানবৎসল,
পত্নীপ্রিয় মানুষটার চোখ লাল, চোয়াল শক্ত, কপালে ভাঁজ, অনুচ্চ স্বরে অশ্লীল
অভিশাপ, দাঁতে ঘষে যাচ্ছে দাঁত আর হাত পায়ের অস্থিরতায় জেগে রয়েছে, ক্ষেপে
রয়েছে গতি। গতির ম্যাজিক রিয়েলিটি !
এই যাদুবাস্তবের স্পর্শ নিহিত চেতনাস্তরের পরিবর্তন ঘটায়। প্রাণমণ্ডলের
সুপ্ত ও অবদমিত অনুভূতিমালার আকস্মিক রূপবদল, অবচেতনের হাতে উঠে আসা
চালিকাশক্তি আমাদের অবাক করে। তবু একথা প্রমাণিত - গতি, সভ্যতার
স্তরান্তরালে লুকোনো পাশবিকতার আগল খুলে দেয়। প্রতিটি বাঁধা ও অতিক্রমণ
আঘাত করে ইগোকে। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, উদারতা, ক্ষমা, সংযম সব সভ্যতার চাদর
তখন দিগন্ত দূরত্বে। দুমিনিট আগে গন্তব্যে পৌঁছনোয় যদিও কোনো পুরস্কার নেই,
অদৃশ্য জয়মাল্য তবু নিজেকেই নিজের অর্পন। শ্রেষ্ঠত্বের কাল্পনিক
নিমেষমুকুট শিরোধার্য করে এইসব মানুষেরা যেখানে থামেন তার পিছনে পড়ে রয়েছে
মৃতদেহস্তূপ - আরো কিছু হেরে যাওয়া ইগো, অপমানিত ব্যক্তিসত্বা,
অ্যাসফাল্টের গায়ে জমে থাকা থকথকে কালচে রক্ত, রক্তের ছিঁটে মেখে অথচ ছুটে
চলা দম্ভটায়ার।
এবং জানা রয়েছে, গতি যেখানে শেষ তার পরেও আরো কিছু বাঁচে জাড্যধর্মে।
সুতরাং এই শ্রেষ্ঠবোধ, প্রতিস্পর্ধী দর্প, পথে ও স্টিয়ারিং এ শেষ নয়, আরো
কিছু; থেঁতলে যাওয়া লাশের দিকে থুতু ফেলে চলে যাওয়া, পাশ কাটিয়ে যাওয়া
দুমড়ানো গাড়িটার, যেটা আর খানিক পরেই চালক ও আরোহীসহ জ্বলে উঠবে বিস্ফোরণে,
শোকজের পরের অ্যারোগেন্স, জাস্টিফিকেশনে কৃতকর্মের প্রতি অননুতাপ - জাড্য
এই সবকিছুর পিছনেই।
আমরা মনে রাখব, এই আলোচনা সম্পূর্ণত: গতি ও গতিদিব্যতা নির্ধারিত মনস্তত্ব
নিয়ে, রোডরেজ ও তার হেতুনির্দেশমাত্র� � এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের
শিল্পায়ণ-বুলডোজারের কোনো সম্পর্ক নেই - রক্ত ও লাশ কোনো বিশেষ গ্রামের
সম্পত্তি নয়, অ্যারোগেন্স ও জাস্টিফিকেশনের কোনো দ্বৈত ইঙ্গিত নেই।
মাল্টিন্যশনালে কাজ করে খাই। এখনো বাড়ির দোতলা তোলা বাকি। নিজেকে একটা
কম্পিউটার কিনে দিতে হবে শিগগিরি। এখন কোনোরকম রাজনৈতিক কূটকচা৯র মধ্যে আমি
নেই। আমাদের ব্যাচের দুটো ছেলেকে মাওবাদী সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তুলে
নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শোনা যায়, আর তাদের এখনো কোনো পাত্তা নেই। সুতরাং আমি আর
কোনো বিতর্কিত শিরোনামের অংশ হতে চাই না। গতি এখানে শুধুই গাড়ি সংক্রান্ত
এবং রোড রেজ-এর অর্থ নিতান্ত আভিধানিক। গতি ও অগ্রগতির সূক্ষ্ম পারস্পরিক
অন্তর্লীনতাকে আমি এতদ্বারা সজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করছি। পাঠক করছেন কিনা,
লেখাটি পুনর্বার পড়ে দেখছেন কিনা, তার দায় ও দায়িত্ব নিতেও স্বত:ই
অসামর্থ্য।
=====================
পাঠপ্রবেশকঃ ২৫শে মার্চ, ২০০৭ তারিখে গুরুচন্ডা৯-র
কূটকচা৯ বিভাগে প্রকাশিত। কলামের জন্যে এই লেখা ফরমায়েশি, তবে সমসময়ের
প্রতি অশ্রদ্ধায় লেখা।
Wikipedia : Road rage is an aggressive or angry behaviour by a
driver of an automobile or other motor vehicle. Such behaviour might
include rude gestures, verbal insults, deliberately driving in an unsafe
or threatening manner, or making threats. Road rage can lead to
altercations, assaults, and collisions which result in injuries and even
deaths. It can be thought of as an extreme case of aggressive driving.)
বিষয় নিয়ে কিছু বলার থাকেনা, কেননা এই লেখার কিছুদিন আগেই
১৪ই মার্চ নন্দীগ্রাম হয়েছে। রাজ্য ও দেশের, মানুষের অগ্রগতি - গতি - গতির
নেশা - গর্ব - Road rage এর সমস্ত লক্ষণের সাথে এভাবে কাঁটায় কাঁটায় মিলে
যাবে ভাবিনি। এই লেখা আমার মাথা ঝুঁকে আসা লজ্জার।
No comments:
Post a Comment