দীপাবলী 2005...
মেরিন ড্রাইভ গিয়েছিলাম, সঙ্গে
আরো তিনটে বন্ধু, কালীপূজার অবাক রাতে......
সন্ধ্যে তখন রাতের পোশাক........
আলো আর শব্দ আলো, আকাশ ভরে সূর্য
ওঠে, চাঁদের কুঁচি অপ্সরাদের নৃত্যছন্দে হাসতে থাকে ঢেউয়ের তালে শব্দগুলোর পায়ের ঘুঙুর
উড়তে থাকে প্রত্যেকটা হাসির শব্দ - শিউরে ওঠা ঢেউয়ের শাখায় জ্বলতে থাকা তারার চূর্ণ
মুক্তোপ্রসব ঝিনুক-হাসির স্লিভলেসেরা সামান্য শব্দ আলোর উচ্ছ্বলতায় রাজ্যশাসন, আঁকড়ে
থাকা গোল্লাছুটের শৈশবি নীল পাথরমালা খেলনা, চুড়ি, মাটির বাড়ি ধানের গোলা এমন রাতেও
এমন প্রখর নিয়মবিহীন স্বাধীন রাতেও চোখের আড়াল ঢাকতে থাকে মুখগুলোতে আলোর পর্দা সরতে
সরতে ভীষণ একা সঙ্গীবিহীন মুখ জেগে যায়.... আঁকড়ে ধরা ... বুকের পাশে বলিষ্ঠ হাত আঁকড়ে
বাঁচা... ফুটপাতময় ছড়িয়ে থাকা শীর্ণ হাতে আলোর শিখা বুকপকেটে খুশির সবুজ, নীল করুণা,
একের পর এক আলোর ঝর্ণা চাঁদের চুলে গাঁথতে গাঁথতে হোঁচট খেলে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে প্লাবনমুখর
রঙ আরো রঙ.... গোটা শহর একসঙ্গেই ফাটতে থাকে জমাট বাঁধা উপেক্ষা বা মনখারাপের ফাটতে
থাকা শরীর থেকে সমস্ত ক্লেদ গড়িয়ে পড়ে পথের প্রান্তে ... ঝলসে ওঠে, চোখ ধাঁধিয়ে শহরখানাই
নাচতে থাকে লজ্জাবাসের উড়তে থাকা .... চোখ পুড়ে যায়......
তার আগের দিন মাতেরাণ। পাহাড়ি
জায়গা। সাথে একজন মাত্র।
নেরোল।
স্টেশন টা ডম্বিভিলি থেকে
স্লো ট্রেনে যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। তবে সাথে একটা বন্ধু থাকলে, আর ট্রেনের সামনের
সীটে পা তুলে জানলার পাশে বসে গান গাইতে গাইতে যাওয়া হলে ঘড়ির দিকে খেয়াল থাকে না।
তাই ঠিক কত সময় লেগেছিল বলতে পারব না। গানটাও আগের দিন রাতে ই লেখা।
আগের দিন রাত।
কারোর কারোর মতে ব্যাচেলর ছেলেপিলের
রাত সাড়ে দশটার পরে প্রকৃতস্থ থাকাই অপ্রাকৃত ব্যাপার। তো, ভূতুড়ে নেশায় কাগজ কলম শিশি
বোতল চিরুণি তক্তপোষ - মানে যত রকমের মিউজিকই হয় , বাজছিল। একটা গান তৈরি হয়েছিল।
সে যখন চোখের তারায় অভ্রকুচি
আর কেউ স্বপ্নপাথর সাক্ষী রেখে
দিনান্তে একলা দাঁড়ায় বৃষ্টিপাতে
সে যেদিন রংধনুতে প্রজাপতি
আর কেউ মাটির ছবি শিরায় এঁকে
ছুঁয়ে যায় শিউলি ফুলের নিদ্রাবাসর
পথে ওর আত্মবিভোর পদক্ষেপে
কুণ্ঠিত কমললতা আলপনারা
খোঁজে কার চড়ুই-চপল উচ্ছ্বলতা
আমি ওর মাশকারাতে .... কোমরে
হাত ....
কয়েকটা কুন্দ-সুবাস ধূসর চিঠি
বহুদিন ডাকবাক্সে অপেক্ষাতে
......
সবাই পুরোনো পাপী। চারতলা টলে
উঠলেই পুরোনো স্মৃতির সালোয়ার চুড়িদার সামনে হানা দেয়। লেখাটা যত জঘন্যই হোক, গানটা
তাই তখনও উড়ে বেড়াচ্ছিল ঘরে, যখন কংক্রিটের দেওয়াল ঘেরা মাঠে অপার্থিব পিকনিক সেরে
বিছানায় বডি ফেলল ভালোলাগায় মিশমার তিন বেভুল যুবক।
প্রবীর যখন প্ল্যান্টে বেড়িয়ে
যাচ্ছে, তখন সকাল, আবছা ভাঙা ঘুম শুনল, অরি বলছে - ""আজ মাতেরণ যাব দুজনে,
তাড়াতাড়ি উঠিস।"" ওঠা কি এতই সহজ? উঠলেও খাট জুড়ে দিনের বাংলা কাগজ, এমনকি
ইংরিজিও। শুয়ে বসে, পা ছড়িয়ে সেসব উল্টে বেড়োতে বেড়োতে নাহয় একটু বেলাই হল। হোক না।
বিকেল অপেক্ষায় থাকবে আমাদের।
নেরোল স্টেশনেও ল্যাভেটরি আছে,
যেমন থাকে সব স্টেশনেই, এবং সেটা একেবারে নোংরাও নয়। কিন্তু মাতেরাণ যেতে হলে ট্যাক্সি
ছাড়া বাহন নেই। অটো ও আধা রাস্তার বেশি যবেনা। আর তোমাদের সাথেই গাড়িতে চড়বে কোনো চিকন
গুজরাতি দম্পতি, যাদের দু বছরের বাচ্চা সত্ত্বেও পুরো পিছনের সীটটা দরকার, আর তোমরা
দুজন সামনে ড্রাইভারের পাশে ঘেঁষাঘেষি করে বসে, ফাইণ্ডারে যখন দেখবে স্বামীর কাঁধে
রাখা স্তিমিত মাথাটি, আর রিনরিনে গলায় আধফোটা বোল, সত্যি বলছি, একটুও বিরক্তি আসবে
না - এমনকি যাত্রা শুরুতেই পেট্রল ফুরিয়ে গেলেও না, সকালে দাঁত মাজতে ভুলে গেছ মনে
পড়লেও না, গান চালাতে বলায় ড্রাইভার সাত পুরোনো হাম আপকে হ্যায় কৌন এর ক্যাসেট চালালেও
না। এসবই সত্যি, আর যদি ল্যাভেটরির কথা অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়, তো জেনে রাখো, সে--ই দুপুরে
খাবার জন্যে পাহাড়ের কোলের হোটেলে ঢোকার আগে সেটার দেখা এমনিতেও তুমি পেতে না।
মাতেরাণ যেতে ট্যাক্সি ভাড়া পার
হেড পঞ্চাশ টাকা। নাকি একশো? আসলে টাকা পয়সার কথা মনেই পড়বে না, ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড
থেকেই যখন দেখা যাচ্ছে পাহাড়, উঁচু পাহাড়, গায়ে কুয়াশার চাদর। আর মনে কর তুমি জীবনে
কখনো কোনো পাহাড়ে চড় নি, শুধু মা বাবার কাছে গল্প শুনেছো দার্জিলিঙের। তাহলে তখন সেসব
বিপজ্জনক বাঁক অবলীলায় ঘুরতে থাকা ড্রাইভারের দিকে যদি তাকাও তো দেখবে, স্টিয়ারিঙে
তার মাত্র একটা হাত! পথ পাহাড় কেটে ঘুরে ঘুরেই ওঠে, সেটাই নিয়ম। কিন্তু তুমি ভাবতেই
পারো, দেওয়াল ঘেঁষে যে পাথুড়ে ড্রেন, তাতে চাকা পড়ে যেতে সমস্যা কই, আর প্রতিটা বাঁকে
বাঁকে চমকে ওঠো।
"আরে সোজা হয়ে বোস, আমায়
হেলিয়ে দিলি যে" - অরিজিৎ না বললে বোঝাই যেত না জানলার ধারে বসেও আমি হেলে পড়েছি
ড্রাইভারের দিকেই অনেকটা।
ট্যাক্সি থেকে নামলেই ঘোড়ার মালিকেরা
ঘিরে ধরবে। ঘোড়া!! অরিজিৎ হাঁ... !! "প্যায়দল নেহি যা সকতে সাহাব, লম্বা রাস্তা
হ্যায়।"
-""তুই জানতিস?""
-""না রে ভাই, হিল
স্টেশন। লোকে ঘুরতে আসে - এইটুকুই জানি। আমি তো ভাবতাম উটির মতো কিছু হবে।"
অরিজিতের ও পাহাড়ের অভিজ্ঞতা
বোধহয় উটিতেই শেষ, এমনকি শুরু ও। কলেজ ট্যুরে, আর সেইসব উচ্চণ্ড পাগলামির দিনে, যখন
একটা ট্যুরে গোটা পাঁচেক প্রেম ম্যাচিওর করেছিল সেই উটিতেই।
-"চল্, চল্ হেঁটেই মেরে দিই। অ্যাত লোক তো যাচ্ছেই সামনে
ল্যাণ্ডাগ্যাণ্ডা নিয়ে।"
-উওলোগ তো হোটেল মে যা রহে হ্যায়।
ঠ্যাহরেঙ্গে দো চারদিন। আপলোগোকো আজ হি লওটনা হ্যায় তো...
ঘোড়ার মালিকদের সহজ শর্ত আছে,
কারোর কাস্টমারকে অন্য কেউ নজর দেবে না। ক্রমশ: জঙ্গল শুরু হবে সামনে, অনেককেই ঘোড়ার
পিঠে দেখবে, তোমার আত্মবিশ্বাস ক্রমশ:ই কমতে থাকবে আর দুজনে দুটো ঘোড়া যতক্ষণ না কড়ার
করবে দুশো দুশো চারশো টাকা দিয়ে, ঘোড়াওলারা তোমার সাথে সাথেই হাঁটছে, তোমায় দেখিয়ে
দিয়েছে এন্ট্রি টিকিট কোথায় কাটতে হয় কুড়ি টাকা দিয়ে। কুড়ি টাকা!!
তাই হবে বোধহয়, সামনে জঙ্গল দেখছো, চকচকে লোমশ ঘোড়াগুলো পিঠে সওয়ারি নিয়ে শুরু করছে
হাঁটা, এমনকি মনে পড়ছে, বেড়োবার আগে শুধুমাত্র একবাটি চিঁড়ে ভিজিয়ে খেয়ে এসেছো, এ সময়
মানিব্যাগের ওজন মনে থাকার নয়।
-"বেশ ইয়ে ইয়ে লাগছে রে।"
-"আমারও।"
অরিজিৎ কে আশ্বস্ত করছো কিন্তু
একহাতে সদ্য তিন (?) টাকা বেশি দিয়ে কেনা মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে ঘোড়ার পিঠে তুমিও
খুব স্বস্তিতে নেই। তার ওপর দুজনেরই এটা প্রথম ঘোড়ায় চড়া। দীঘায় চিরু যখন সাহস করে
চড়েছিল, আর নেমে এসে তোমাদের সপ্রশংস দৃষ্টির সামনে বলেছিল, "যখন লাফিয়ে শূন্যে
উঠছি, বুঝলি, টেনশন হচ্ছে ঠিক জায়গায় ফিরে নামব কিনা", সেই সব শব্দ তোমায় ফিরে
পাচ্ছে। নিজের বোতলটা অরি ঘোড়ার পিঠে দড়ি দিয়ে বাঁধিয়ে নিতে পেরেছে, কিন্তু তোমার ঘোড়ার
সহিসের কাছে কোনো দড়ি নেই। উপরে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যাবে এই রফায় চলা।
-"আমি উঁটের পিঠে চড়েছি,
বুঝলি, সেগুলো বিশাল উঁচু, আর পুরো ঢেউ কুচ কুচ কেস।"
আমার এটাই প্রথম, সেটা বলা যায়
না, কিন্তু জঙ্গল ভেদ করে যেতে যেতে টয় ট্রেনের লাইন পথ কেটে যয়।
-"ইঁহাপে টয় ট্রেন চলতা
থা?"
তা তো চলতোই, কিন্তু বৃষ্টি এসে
সব ঘেঁটে দিয়ে গেছে। মনে পড়ে ট্যাক্সির রাস্তাও পাঁচ বার কেটেছিল টয়ট্রেন লাইন? ড্রাইভার
ই তো হিসেব দিয়েছিল। তুমি বড্ড ভুলে যাও। তা ভোলারই কথা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাল পথ
দিয়ে চলেছো। সাথে দুজন চলেছে রাস্তা দেখিয়ে ঘোড়া তাড়াতে তাড়াতে মুখে অদ্ভুত শব্দ করতে
করতে, মাঝে মাঝে মাথা সড়িয়ে নিচ্ছ গাছের ডাল এর জন্যে। গান এখন একটাই, অনিবার্য ভাবে,
আর তা গাইছোও, "হেথা মাথা উঁচায়ে দিল ঘুম, যত আদিম মহাদ্রুম"" ।
- উধার এক পয়েন্ট হ্যায় সাব,
দেখ লিজিয়ে
-আরে না না, আগে হোটেলে চলো,
তীব্র খিদে পেয়েছে
- লেকিন...
- আরে এই পথেই তো ফিরবো, তখন
দেখা যাবে।
ওকে দাবড়ে, টয় ট্রেন স্টেশনের
সামনেই হোটেলে গিয়ে, দাম দেখে ঘাবড়ে, হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে - খরচ যখন হবেই - লাঞ্চ করে,
শুরু হল যাত্রা ""পয়েন্ট"" দেখার।
পয়েন্ট গুলোর নাম লেখার জন্যে
মানিব্যগ হাতড়ে এক্ষুনি বের করলাম রেখে দেওয়া এন্ট্রি টিকিট টা, আর চোখে পড়লো ওগুলো ছিলো ২৫ টাকার। হোটেলের
সামনেই প্রথম যে পার্কে ঢোকালো (তার নাম টিকিটের পিছনে ছাপা ম্যাপে নেই), সেখান থেকে
বেশ পাহাড় দেখতে দেখতে ফুর্ত্তিতে প্রবীরকে ফোন করা হল। সে তখন তীব্র কিচাইনে, মেটেরিয়াল
ভরা ড্রাম তার ""টেম্পোরারি"" ফাটিয়ে ফেলেছে, আর সেফটি ওলারা পারলে
তাকে খেয়েই ফেলে আরকি। শুকনো মুখে ""এনজয় কর"" ছাড়া আর কিছু বলার
ছিল না, কিন্তু আমরা আরো কয়েকজন কে জানিয়ে দিলাম আমরা এনজয় করছি, কারখ তখন ও BSNL এর
টাওয়ার আসছিল, আর সূর্যের আলোয় পাহাড় দেখতে দারুণ লাগে।
এরপর দেখতে নেমেছি
""ইকো পয়েন্ট""। ঘোড়া থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে যেতে হবে ঢালু পথে,
আর হঠাৎ একটুকরো খালি জায়গা বেড়িয়ে এসে বারান্দার মতো ঝাঁকি দেখায় সেসব প্রাচীণ পাথরের
গায় সবুজ, শুকিয়ে যাওয়া ঝর্ণা, এমনকি লোকে টেলিস্কোপ হাতে বসেও আছে ""আদিবাসীদের গ্রাম, ওয়াটার ফলস, এতাবৎ
৫ খানা জিনিস দেখাবে দশ টাকায়। গলা ফেঁড়ে খানিক চেঁচানো হল পিছনে ফেলে আসা সালোয়ারদের
নাম ধরে। এ গাছ, ও গাছ সে গাছকেও কানে কানে শুনিয়ে দিল, সে নাম। আমাদের ও cc, bcc করে
দিল। আরো চারটে ট্যুরিস্ট ছেলে ছিল, বুঝে নিল যা বোঝার। শুধু যে বাচ্চাটা ৫ (?) টাকায়
বল ছুঁড়ে বা খেলনা বন্দুক ছোঁড়ার খেলায় নিমন্ত্রন করল, বা তার মা (?) পিছনে জঙ্গল নিয়ে
সন্ধ্যের মুখে অমন একলা বসে ছিল চকলেটের পসরা নিয়ে তাদের ভুলতে হবে তোমায়। কারণ ততক্ষণ
তুমি জেনেছ দুশো টাকা হল ৫ টা পয়েন্ট দেখানোর ভাড়া। এমন আছে ৭, আর ১১ পয়েন্ট দেখানোর
ভাড়াও, আর ভাবছো, নাহয় হেঁটেই আসতে বা নাহয় ক-একশো বেশিই যেত কিন্তু এখান থেকেও তোমায়
অপূর্ণই ফিরতে হবে। সানসেটের কাস্টমার ধরতে হবে বলে জলদি ফেরার তাড়া দেবে সহিস, তোমায়
দেখাবে একটা প্রায় খাড়া ধাপ, যেখানে নাকি ট্রেকিং করতে আসে সাহেবি স্কুলের ছাত্ররা,
আর চটতে শুরু করেছো তুমি।
খাণ্ডালা পয়েন্ট দেখতে গিয়ে বাঁদরে
ভরা রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে তোমরা তাই বলাবলি করছো এখানে ফালতু বসে ভাঁটিয়ে নেবে অনেকক্ষণ,
তাছাড়া তখন বুঝেছো অতক্ষণ টানা ঘোড়ায় চড়াও মোটে সুখের কথা নয়।
আদতে খাণ্ডালা পয়েন্ট থেকে খাণ্ডালা
দেখা যায় না। একজন দেখাবে বলে ২০ টাকা দাবি করেছিলো। ভদ্রলোক স্ত্রী-পুত্র সহ সেই টেলিস্কোপওলা
ছোকরাকে চাটছিলো, আমরা যখন ঢুকলুম। ছোকরার বক্তব্য এখনো সন্ধ্যে হয় নাই, হলে খাণ্ডালা
র আলো দেখা যায় ওখান থেকে। যে আধঘন্টা বসে ছিলুম , ছোকরা জানালো তার ১২ ক্লাস অবধি
পড়া, কমার্স। গাছের গায়ে তার ব্যাগ, আর বোধহয় টিফিন বাস্ক রাখা ছিল। ফেরার পথে দুটো
মেয়েদের চটি কেন পড়ে আছে, আর সেই মেয়েদুটি কোথায় গেল, সে নিয়েও তাকে খোরাক করা হল বিস্তর।
আরো একটা, সেই সকালে ফেলে আসা
পয়েন্ট দেখে ফেরা। গেটের মুখে, - "ওদিকে আবার কি? ঐ পথে?"
তখন সাড়ে পাঁচটা। - "ইঁহাকা
এক নম্বর পয়েন্ট, প্যানোরমা পয়েন্ট। আউর শ শ রুপায়ে করকে দেঙ্গে তো দিখা লাতে হ্যায়।
"
-""নিকুচি করেছে তোর
শ শ।"" ততক্ষণে আমার ঘোড়া বদল হয়েছে। মাঝপথেই সে অন্য কাস্টমার নিয়ে, এমনকি
আমার জলের বোতল নিয়ে, হ্যাঁ যেটা বাঁধা গেছিল হোটেল থেকে দড়ি নিয়ে, এগিয়ে গেছে, আর
নতুন ঘোড়ার সহিস ধমক খেয়ে সে বোতল আনতে গেছে তার পিছনে, এমনকি নিয়ে ফিরেছেও।
"পায়ে হেঁটেই যবো"। ভাড়া মিটিয়ে পা চালালাম দুজনে। পৌনে সাতটায় পুরো ঘুটঘুটে
অন্ধকার হয়ে যায় আর জঙ্গুলে রাস্তা জেনেও।
এই আরম্ভ অসম্ভব, বিপর্যয়, অন্যরকম
বিকেলটার। সূর্য তখন বেশ গরম। দুটো ঘোড়া আর সওয়ারি, ফিরে আসছে, "পথ তো বন্ধ, রাস্তা
জুড়ে ধস নেমেছে"" ।
""ধুস, সেরকম হয় কখনো!
চল্ তো দেখি!"" দেখতে পেলাম মাত্র একটা, দুটো, তিনটে বন্ধ রাস্তা। একলা
হাঁটা প্রায়ান্ধকার গাছের ছায়ায়। মাটির উপর - নাম জানি না - হালকা হলুদ ফুল ফুঁটেছে,
ভীষণ ছোট্ট, পায়ের চাকায় ধ্বস পেরিয়ে, এগিয়ে যাচ্ছি, কারণ শিঘ্রি সন্ধ্যে নামবে। দুখান
বিশাল তেঁতুল বিছে দেখতে পেলাম। বুক দুর দুর। কিন্তু হঠাৎ এক্কেবারে খাদের ধারে এগিয়ে
এলো পথ। সেখান থেকে অপার অসীম আকাশ জোড়া পাহাড় দেখার কী আনন্দ, কী যে ভীষণ অদ্ভুত সেই
আধভাঙা ..., তার চূড়ার কালো রং। নীচে তাকাও, এক্কেবারে নীচে, খাদে আধশুকোনো নদীর আভাস দেখতে পাবে, জল তখনো সব
শুকোয় নি। আর যেটা ঠিক পয়েন্ট বলে সনাক্ত হয়,
জং ধরা এক সাইনবোর্ডে, আগের লোকের খাবার প্যাকেট, গোল্ডফ্লেকে, তার বর্ণণা দিই এমন
ভাষা আমার কোথায়!!
ছবিটা আঁকা খুব কঠিন ছিল, তবুও
চেষ্টা করা যাক। প্যানোরমা পয়েন্ট যেটাকে দাবী করলাম সোমনাথ আর অরিজিৎ, সেটা গোটা পাহাড়টার
একটা বারান্দা। শেষের আগের পাথরটায় বসলে একটা সিগারেট ওকে ধরাতেই হল। হতই। নিয়ম। সামনে
আর কিছু নেই। নীচে আছে। তা ধর মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে যেমন দেখায়, বা উপগ্রহ থেকে, হাল্কা
সবুজ আর খয়েরি মেশানো রঙ। বাঁকা বাঁকা লাইনগুলো নদী, এমনকি বাড়ির মতো কিছু ছোওওট্ট
ছোওওট্ট বিন্দু, কিছু হ্রদ, ঝিল গোছের ছবি, আর হাল্কা একটা কুয়াশা রঙের মায়া.... দূরে
অনেক দূরেও ঘিরে থাকা পাহাড় গুলো, এমনকি বি এস এন এল এর টাওয়ারও কোনো চূড়োয়... আর আজব
আজব মুখ এক একটা পাহাড়ের, মেঘগুলোরও এমনকি মুখ আছে... সবাই খুশি, আসলে খুশির জীবাণু
উড়ছে বাতাসে, আর এতটা পথ হেঁটেও তিলার্ধ ক্লান্তিহীন অরিজিৎ কি যে বলছে - " এখানে...
আসলে... এত বড় ... বিশাল... "" আসলে
বিশালের সামনে আপনা থেকে মাথা ঝুঁকে আসে, অস্ফূটে মন্ত্র জাগে ঠোঁটে, স্তব বা স্তুতি...
""চুপ কর, কান পেতে শোন একবার, "" - ""কি"" - ""নৈশব্দের শব্দ"".............
........
সত্যি কি যেন একটা বয়ে যাচ্ছে,
হয়তো অনেক যুগের আগের কোনো মন্ত্র, শব্দের তো মৃত্যু নেই,হাজার বছর আগের গিরিগুহায়
কোনো ঋষিস্তোত্র... হবেও বা, নাকি কোনো ঝর্ণার শব্দও শুনলাম, বয়ে যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে
না ... হঠাৎ কেন জানিনা তুমি বলে ওঠ,
""এইখানে একেবারে খালি গায়ে দাঁড়াতে হয় সভ্যতার চিহ্ন সব মুছে দিয়ে শরীর
থেকে"", অরি তাকায় চোখ তুলে তোমার দিকে, সিগারেট শেষ হয়েছে, ভালো করে দ্যাখে
তোমায়, বিশেষত: মাথার দিকে , ঢোক গেলে, - ""হাওয়াতেই একটা নেশা আছে না??
চ অনেকক্ষণ হল।" সে তোমাকে চেনে, সম্ভাব্য
পাগলানির আভাস পেয়েই ধাতস্ত হয়, ""এক্ষুনি আলো নিভে যাবে, আর তিন জায়গায়
রাস্তা খারাপ, আর বিছে "", শেষ শব্দটা তোমাকেও ভাবায়, ""চ, তাহলে",
কিন্তু ফেরাটা তো এত সহজ হয় না। গান আসতে থাকে ভিড় করে গলায় ঠোঁটে, আর যদিও তুমি মোটে
ভালো গাও না, তবু সব পাহাড়, গাছ-পালা আর গিরিখাতকে ঝর্ণাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তুমি গাইতে
থাকো, "পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়, যেথা সময় থমকে আছে বটের ছায়...." কিছুদিন
আগেই তোমার প্রিয় কেউ মনে করিয়ে দিয়েছে এটা, "down
the way where the nights are gay, and the sun shines daily on the mountain top", আর যত নচিকেতা,
তোমার স্কুলজীবনে মুখস্ত করা গান, এমনকি অরি-অরিজিৎ ও গলা মেলায়। হ্যাঁ আলো নেভার আগেই
ফিরেছিলাম, আরো একটু উঁচুতে ওঠা যেত প্যানোরমা পয়েন্টের, তুমি অরিকে দোষ দাও। তার ও
নিশ্চয়ই অনুতাপ হয়, কারণ সে চুপ থাকে।
ফেরাটায় আর কোনো রোমাঞ্চ থাকতো
না, যদি না সেই পাহাড়ের ঘোরালো পথে নামতে নামতে নীচের, পাহাড়ের গ্রামে শহরে জ্বলতে
থাকা অজস্র জোনাকি, নানা রঙের - জোনাকি আলো- দেখতে দেখতে তুমি নামতে। সেই বিপজ্জনক
বাঁকগুলো, আর আবার তুমি জানলার ধারে, তোমরা ড্রাইভারের পাশে।
এই পর্যন্ত লিখে আর না লিখলেও
চলে, কারণ স্টেশনে প্রায় আধঘন্টা বসে থাকার মধ্যে একজন দারুণ দেখতে বৌদি ছাড়া উল্লেখ
করার আর কি আছে? কিন্তু টিকিট কিনতে যাওয়ার আগে যে তুমি জীবনে প্রথম একটা সিগারেট টানো,
সেটা লিখবে না? একটুও কাশলে না, ধোঁয়াটা গিলতে গিলতে এমনকি টের পেলে গলার মিউকাসে বিঁধে
যাচ্ছে সাসপেণ্ডেড কার্বন পার্টিকল, কৌমার্যমুক্ত হলে নিকোটিনে, লিখবে না? কেন হঠাৎ
দু টান সিগারেট খেলে সোমনাথ, খেয়ে দেখলে ! ফিরে আসার পথে তো সুরজিৎ কেও টেনে আনলে,
আর রাত্তিরে....
না: মাতেরাণ ভ্রমণ যখন শেষই হয়ে
গেছে, ফিরে আসা যাক, লেখার নেশা সর্বনাশা....
তাও তো অনেক কিছু বলা হয় না।
নেরোল, যেটা শুনতে, সেটা নেরল ("Neral") । আর মাতেরাণ, "Matheran"
তার দেখার মত জায়গাগুলোর নাম - গারবাট পয়েন্ট, আলেকজাণ্ডার পয়েন্ট,
রামভোগ, অলিম্পিয়া রেস কোর্স, লিটিল চক পয়েন্ট, চক পয়েন্ট, ওয়ান ট্রি হিল, শার্লট লেক,
ইকো পয়েন্ট, লুৎসা পয়েন্ট, পর্কিউপাইন পয়েন্ট, মাংকি পয়েন্ট, হার্ট পয়েন্ট, প্যানোরমা
পয়েন্ট। থাকার, মানে রাত্রিবাসের উপযোগী দিব্য হোটেল পত্র আছে -যেমন হোটেল প্যানোরমা,
.... ইত্যাদি, প্রভৃতি।
টয় ট্রেনের ট্র্যাক সারানো হয়ে
গেলেই আরেক অন্য রকম ম্যাজিকের শুরু , যদি সম্ভব হয়....
ঘোড়া ছাড়াও আরেক রকম যাতায়াত
- জুজুর থাবা খেয়ে বেঁটে হয়ে যাওয়া কলকাতার রাস্তার টানা রিকশা গোছের, সাধারণত: একটু বয়স্ক, বা শিশুরা চড়ে, বসলে মাটি
থেকে বড়জোর তিন বিঘৎ উপরে থাকবে দেহের নিম্নতম বিন্দু। টেনে নিয়ে যাবে কেউ -
""গাইড"" বললে ভাষাও লজ্জা পাবে।
এন্ট্রি পাস নিয়ে যেখানে ঢুকলে,
তার পর কোনো ধোঁয়ার গন্ধ নেই, বিধিবদ্ধ আপত্তি আছে, তাই পেট্রল ডিজেল চালিত, কিংবা
এমনকি সাইকেল ও চলবে না। মাঝে মাঝে চোখে পড়তে পারে ঠেলায় করে পাঁচ ছ জন ঠেলে তুলছে
সবজী, স্টেশনারী, খাবার জল, বিয়ার, হুইস্কি, এবং আরো আরো যা সভ্যতার ইদানীং দরকার।
সেই ঘাম, সেই প্রাণান্তকর পরিশ্রম - হেঁইয়ো সঙ্গীত দেখে মনে পড়তে পারে চেনা হওড়া বাজার,
স্টেশন চত্ত্বরের মুটে, কুলি...
ঘোড়ার সহিসেরাই তোমায় জানাবে,
মাত্র এক মাসেরই তো সিজন, আর ঘোড়া পোষা সারা বছরের দায়, নিজে খাও বা না খাও, ঘোড়াকে
খাওয়াতেই দিনে প্রায় একশ টাকা খরচ হয়, আর তারপরেই প্রশ্ন করে বুঝতে পারবে না, সত্যি
কোন সময়ে আদৌ ট্যুরিস্ট আসে না এখানে, মানে কোনটা অফ সিজন! জানবে শুধু সানসেট দেখাতে
আলাদা স্পেশাল ট্রিপ হয়, এবং এই সহিসেরা দিনে চারবারও গোটা পথ হাঁটে কোনো কোনো দিন,
তোমার-তোমাদের সঙ্গে। ঘোড়ার কথা শুনবে, কিভাবে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে একটা ঠ্যাংকে
বিশ্রাম দেয় ওরা পর্যায়ক্রমে। দেখবে হেলমেট মাথায় এঁটে কেউ কেউ দস্তুরমতো রাইডিং শিখছে
- টগ্ বগ্ টগ্ বগ্ ....
এই ভালোলাগা গুলোই তো থেকে যায়,
নইলে পরদিন মেরিন ড্রাইভে কুইনস নেকলেস জুড়ে যখন আকাশ আলো করে দিয়েছে বাজির রং, সুমেরুর
এস এম এস কেন পাবে -
"আলোয় আলোয় পুড়ে যায় শহর
সেই সব দিনে মনে রেলগাড়ি
পাখায় ফড়িং, নামগান অষ্টপ্রহর
ঝরঝর মুখর, গুড়ের নাগড়ি
ফুলেতে বোসো না ভ্রমর।""
......আর যদিও রোমিং এ আছো কেন
ফোন করতে থাকবে সব প্রিয় লোকেদের - ফোন, মিস কল নয় - ভাবো, তখন তোমার ব্যালেন্স ও কাটছে
মোটে মিনিটে দুটাকা।
(যখন তুমিও জানো এই লেখা লেখার
ক"দিন আগেই তুমি পড়েছ ইন্দ্রনীল সমূহের ডাকিনীবিদ্যা আর আলোকিন্নর)
No comments:
Post a Comment