দেখে এলাম কিংকং, সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে ন'টা। এমন নয় যে আমি জানিনা গল্পোটা, কিন্তু টাইমস অফ ইণ্ডিয়া দেখি সাড়ে চার খানা স্টার মেরেছে রেটিং এ, তাইলে তো দেখতেই হয়। তা দেখলাম বটে একখান সিনিমা, ২৫ ফুট গেরিলা, সাথে বিকুষ্টি কালো আদিবাসী সম্প্রদায় আর ডাইনোসর ফ্রী।

শুনে হিংসে করবেন না, একটা জোঁক একটা লোককে মাথার দিক থেকে স্রেফ গিলে খেয়ে নিল। বড়ে পোকা মারতে মেশিনগান চলছে ট্রা রারারারা গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে পাহাড়ী উইপোকা, বাজপাখির মতো মশা, আর নায়িকা ..... এমনকি গোরিলাকেও ভালোবেসে ফ্যালে আর গোরিলাটা ..... সত্যি ভালোবাসাই যায় অবিশ্যি ....... কি অভিমানই না করল, চোখে জল আসে আহা !!

শহরের সবথেকে উঁচু ফ্ল্যাটবাড়িটার সবথেকে উঁচু ছাদে চড়ে আত্মহত্যা করল। তারপর টাইটানিকের নায়কের মতো জাস্ট পড়ে গেল, বাতাস কাটতে কাটতে হুস্স্স্স্স্স্স পড়তে থাকা তার কালো দেহ, ইস্স চোখের কোল এখনো ভিজে !!

যখন নায়িকার দিক থেকে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে সূর্যাস্তের সামনে এসে বসছে, আর নায়িকা ভেবেছে বুঝি সার্কাস দেখাই নি বলে অভিমান করেছে, পাথর
তুলে লোফালুফি রত নায়িকার দিকে সেই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি, আর সামনের অপার্থিব সূর্যাস্তের দিকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া - আহা দেখা যায় না!! আমার রুমাল পুরো ভিজে গেছিল হল থেকে বেড়োবার আগে। মাঝে তো মনেই হচ্ছিল, ধুস্, ন্যাকা নায়কটা চুলোয় যাক, আমি স্ক্রীপ্ট লিখলে নায়িকাকে কঙের সঙ্গেই সেই জঙ্গুলে দ্বীপে পাঠিয়ে দিতুম।

আর, সে কি ডাইরেক্টর!! সে কি কনফি!! পাঁচ পাতার স্ক্রীপ্ট, শুধু শুরুটুকু, ভাঙা ক্যামেরা, দুজন অ্যাক্টর, একজন সাউণ্ড রেকর্ডিস্ট, একজন সহকারী, পিছনে ঝুলছে ওয়ারেন্ট, সিঙ্গাপুরের নাম করে পাড়ি দিল অজানা দ্বীপে শ্যুটিং করতে। ভাবুন, দেখতে পাচ্ছেন বিশাল মাকড়শা, দৈত্যের মতো আরশুলা, আর টিরানোসরাস রেক্সের সাথে কিং কং এর মারামারি !! তোফা তোফা। পালে পালে ডাইনোসর দৌড়চ্ছে আর পায়ে পায়ে পিষে যাচ্ছে টিরানোসরাস জাহাজের মাল্লা সিনেমার সহকারী -কি শিহরণ!! উ: !! ওরে পাগোল , একবার দেখে আয়,
শতাব্দীপ্রাচীণ আদিবাসীরা কাঠের খাম্বা পিটিয়ে জঙ্গল জাগিয়ে দ্রিম দ্রিম বাজনায় গলায় হাড়ের মালা পরিয়ে দুর্বোধ্য মন্ত্রে নায়িকাকে পুলিচালিত সেতুর থ্রু-তে পঠিয়ে দিল কিং কং এর কাছে, পায়ের নীচে দিয়ে জাস্ট বয়ে যাচ্ছে আগুনের নদী - আর জাহাজ থেকে অপহৃত নায়িকা দুহাত টান করে উপুরে বাঁধা - নিষ্পাপ বগল - অকস্মাৎ চেয়ে দেখল সেই ২৫ ফুট কালোরোমশ - তুলনা হয়??

দেওয়াল বললে বুঝতে পারবে না অমন রাক্ষসপুরী, জঙ্গল বললে বুঝবে না অমন মাকড়শার জাল, গাছের ঝুরি, লতাল্মের দড়ি-দড়ায় দোল খেতে খেতে
ঝুলন্ত নায়িকা ঝুলন্ত টিরানোসরাসের মুখের কাছে একবার আসছে, আর কামড়গুলোকে হাওয়ায় অসমাপ্ত রেখে দোল খেয়ে সরে যাচ্ছে!! পাগোল পাগোল!! উফ্ !! আর ইয়া লম্বা বাঁশে দোল খেয়ে পোলভল্টের যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে পাহাড় থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়া সে পিশাচবৎ আদিবাসীরা!! চোখ ওল্টানো, চুলে ঢাকা মুখ, চোয়ালের নীচে দাঁত - যেন দানবপুরীর দু:স্বপ্ন!!

দিনে স্রেফ একবার শো-এর সময়ে নায়িকাকে দেখতে পাবে এই আশায় ভর করে কিংকং হাতের স্টেনলেসস্টীলের হাতকড়াকেও পাত্তা না দিয়ে পাবলিক স্টেজে এসে দাঁড়ায়, বন্দী, আর নায়িকার বদলে তার সামনে তুলে দেওয়া হয় অন্য একটি মেয়ে!! চোখের দৃষ্টির সেই পাল্টে যাওয়া, নাকে ক্লোরোফর্মের বোতল ভাঙার স্মৃতি চুরমার করা সেই গর্জন!! আহত প্রেমিকের জন্যে থাক দু ফোঁটা চোখের জল।

আমি মুগ্ধ, আমি মুগ্ধ, যখন রাজপথে পড়ে থাকা কিংকং এর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত পুলুশবাহিনীর সামনে এসে ডাইরেক্টর বলে যায়, হেলিকপ্টার নয়, দানবকে খুন করেছে আসলে রূপ -নারী এক - মোচড় দিয়ে ওঠে বুকে মাইরি বলছি। ভেবে দ্যাখো আক্রমণোদ্যত গর্জমান জঙ্গী বোমারু বিমানের সামনে শহরের উচ্চতম প্রাসাদচূড়ায় উঠে আড়ালহীন হয়ে যায় সে স্বেচ্ছায়, আর বুকে চাপড় মেরে বন্য চিৎকারে হাত বাড়িয়ে ধরে নেয় প্রায় মেগ-২৪, তুলে আছাড় মারে শূন্যেই ভাবা যায়!! ডানা ছিঁড়েই নিল সে বিমানের - যেন ফড়িং!!

আহা সেকি অনুভূতি, অসাধারণ! আমি বহুদিন মনে রাখব সেই পশুপাখির খাঁচায় বসে চিত্রনাট্যের স্ক্রীপ্ট লেখা নায়ককে - কি ডেডিকেশন - পেন চুরি করে নিয়ে যায় চা দিতে আসা ছুটকো বালক, সে জানতেই পারে না - টাইপরাইটার বেজে চলেছে কি ব্যঞ্জনায় খট খট- স্কাল আইল্যাণ্ড। এখেনে বলে লাভ নাই, এতো গভীর অনুভূতির দাম কি সবাই দিতে পারে? যখন কিংকং এর মুঠোয় ভেসে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও লি ছোড়ে ক্যাপ্টেন আর তার আগে সেই অনাথ ছুটকো ছেলেটাকে বলে জাহাজে ফিরে যেতে - তুলনা পাবে শহুরে সভ্যতায় ??

না:, আর লিখবো না, লিখে কি বোঝাতে পারব সেই অনুভূতি - শহরের ছাদে বসে নায়িকাকে অস্তসূর্যের দিকে দেখিয়ে কিংকং কিভাবে বাঁ হাত মুঠো করে বুকে রাখে, যেমন নায়িকা রেখেছিল, জঙ্গলের পাহাড়ি চূড়া থেকে দেখে শেষ সূর্যাস্ত, কিং কং এর হাতের পাতায় নিশ্চিন্তে
ঘুমিয়ে পড়ার আগে? চোখ, শব্দহীন পটচোখে গড়ে উঠতে থাকা ভাষা - আলতো অভিমান, ছোট্ট মানবীটিকে নিয়ে খেলা, আর সেই অলীক সার্কাস ম্লান মিশে যেতে থাকে সেই গোধূলীবেলায় - আমদের কবিরাই তো বলেছেন, কনে দেখা আলো!!

এ অলীক মায়াখেলায়ও যদি মনে রাখি বাক্য ও বিন্যাসের টেকস্ট, ধিক্কার, আমি তবে কিছুই দেখিনি, কিভাবে অর্থ সমৃদ্ধির শিখর ছেড়ে দেয় মেয়েটা শুধু দৈত্যাকার প্রেমীটিকে ধোঁকা দেবে না বলে, নামহীন, আলোহীন ব্যালেড্যান্সের গ্রুপে যোগ দেয় আর তার সামনে দিয়ে উড়ে যায় ছেঁড়া পোস্টার, শহরময় সামরিক দাপাদাপির মধ্যে, কিং কং বেরিয়ে এসেছে শিকল ছিঁড়ে - সে দেখেছে তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দীকে সেই স্ক্রীপ্ট রাইটার। কিভাবে সিনেমার প্রোডিউসার, ডাইরেক্টরকে মুখের ওপোর বলে সিনেমা যে করছো তাতে খোলামেলা মেয়েরা থাকছে তো, আর ডাইরেক্টর রীল উঠিয়ে নিয়ে চলে আসে সেই অজানা জঙ্গলে যেখানে কিংকং স্রেফ দুটো চোয়াল ফাঁক করে খতম করে দেয় টিরানোসরাস রেক্স, আর শেষ বার নাড়িয়ে দেখে নিতে থাকে দুটো দুলন্ত চোয়াল - আমার নায়িকাকে খেতে এসেছিস হতভাগা!!

যদি বৈষ্ণব পদাবলী না পড়ে থাকো তো দেখোনা, কিভাবে বুঝবে সেই ব্যথা - অদেখা ভালোবাসার প্রথমবার মুখোমুখি হতে এসে নায়িকা কিভাবে আয়নায় প্র্যাকটিস করে বারবার, আর ভুল লোককে ধরে বলে যেতে যেতে থাকে - আমি আপনার লেখার পোচোন্ডো ফ্যান, এ সি, এয়ার কুলার, কিন্তু আপনাকে একেবারেই আপনার ছবির মতো দেখতে লাগে না, আর কি অদ্ভুত লেখেন আপনি? (ব্র্যাকেটে - ""আমাকে নাও"")। এভাবে হয় না, পোস্তোর গন্ধ নাকে নিয়ে কি আমি বলে যেতে পারবো, কিভাবে স্ক্রিপ্ট রাইটার নিজের লেখা কমেডি নাটকে ঢুকিয়ে দেয় তার চোখের জল - নায়িকার মুখে - আমাদের ব্যপারটা হয়ত কোনো পরিণতির দিকে যাচ্ছিল - কিন্তু সেও আর কিছু বলল না, অনেক অপেক্ষা করলাম আমি, তবুও সে আর কিছুই বলল না!! আহা, কলজে চিরে রক্ত বেরিয়ে আসে !!

আলুপোস্তো!! সেই স্বর্গীয় স্বাদ জিভের অনুভুতি বেয়ে চোখে নেমে আসবে, যখন দেখবে জাহাজের ডেকে অভিনয় করতে করতে অবশ, অসাড় হয়ে যাচ্ছে নায়িকা, নায়ক স্ক্রীপ্ট রাইটার তাকিয়ে আছে তার দিকে আর ডাইরেক্টর বলল, রু অন্যদিকে যাও, আমাদের একটু শ্যুটিং করতে দাও, ঠিক চোখে পাবে সেই স্বাদ, সেই বিমোহী স্বাদ। বিদায় জনতা। বিদায়, এই মহান ট্র্যাজেডির কথা আমি মাইকে মাইকে প্রচার করে যাবো, পৃথিবীর শেষ সমালোচনার সন্ধ্যে পর্যন্ত, তাপ্পর, দুগ্লাস টেকিলা গিলে চোখের জল মুছে ঘুমিয়ে পড়ব।