ঝরা পাতাগুলি

Thursday, July 11, 2013

বর্ণাশ্রম

""আমরা সমাজটাকে চারটে ভাগে ভাগ করেছি।''

মার্ক্স এঙ্গেলস কি অপর গোলার্ধ কাঁপানো কোনো দেড়েল অর্থনীতিবিদ বা সমাজতাত্বিক নয়, এ ঘোষণা একটি প্রাইভেট সংস্থার প্যানেল রিসার্চ ফিল্ড সার্ভেয়ারের। ভারতবর্ষের জনসংখ্যার, একশ কোটি জনসংখ্যার, চারটি "SEC" অর্থাৎ "Social Economical Class"A, B, C, এবং D । অমর্ত্য সেন বিগলিত হবেন, মনমোহন সিং উৎফুল্ল ও আবুল কালাম মশাই আত্মহারা হয়ে পড়তে পারেন এমন সহজ সাধারণ আর্থসামাজিক পরিকাঠামো বিভাজনে এবং আমাদের দাবি ব্যপারটাকে অবিলম্বে পাঠক্রমের অন্তর্ভূক্ত করা হোক। বৈচিত্রের চোখধাঁধানো বর্ণবাহুল্যের এমন নিপাট টেট্রাক্রোমাটিক সমাধানসূত্রের হাতুড়ি ধামসে দেখতেই পাচ্ছেন যে কোনো জনগণতান্ত্রিক কর্মসূচী পরিকল্পনার কি মসৃণ রাজপথ সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে TAM Media Research Pvt. Ltd. , মফতলাল চেম্বার, মুম্বাই-১৩। (শুড্ঢাপন্থীদের জন্যে,) TAM এর পুরো কথাটা হল টেলিভিসন অডিও মেজারমেন্ট। গুরুচণ্ডালী পড়ে অবসর বিনোদনকারী বাঙালী আঁতেল চুনোপুটিকূল নাই চিনতে পারেন কিন্তু তাবৎ টিভি চ্যানেলওয়ালা রাঘব বোয়াল যেমন স্টার, জি, সাহারা, সোনি-র নাম নিলেই কেস কচলে যাবে। এতক্ষণের তাচ্ছিল্যমাখা আধবোজা গুলি গুলি চোখ দুমদড়াম্ হাফ-আখড়াই মেরে হামলে উঠবে জানি - ""কে সে? কে সে!"" রব-এ। তবে জানানো যাক, এলি তেলি নয়, ট্যাম রিসার্চ পাক্কা রুস্তম চিজ, যে কিনা টি. আর. পি. রেটিং দেবার ইন্ডিয়ার একমাত্র কোম্পানী। মনোপলি ব্যবসা। ক'দিন আগে বিদেশী আরেকটা কোম্পানী এদেশে গুটি গুটি পায়ে মার্কেটে নেমেছিল, এখন মার্জার হয়ে গেছে। মানে, বেড়াল নয়, কোলাবরেশন। ট্যামের ল্যাব সুইজারল্যাণ্ডে, মেসিন হল গিয়ে রাশিয়ার "স্লোভানিয়া"। কিসের মেসিন জানতে হলে মুখ বুজে নিচের পুরো থিওরি পড়ে নিতে হবে। কোনো ট্যাঁ ফোঁ নয়।

ভারতবর্ষের যে চারটি আর্থসামাজিক-এ-বি-সি-ডি, তার ভিত্তি পরিবারের লোকেদের শিক্ষা ও জীবিকা। (১) M.B.B.S., L.L.B., Engineer, Graduate অর্থাৎ ডাক্তার, উকিল, সিনিয়ার অফিসার - এরা সব A Class, হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল টীচার হলেও কিন্তু সিনিয়ার অফিসার আওতাভুক্ত। নির্ঘাৎ বড়সড় লাইসেন্সড ব্যবসায়ীরাও A Class কেননা, (২) গ্র্যাজুয়েট ক্লার্ক বা হায়ার সেকেন্ডারী পেডিটেটর মানে হল B Class। এবার এই পেডিটেটর বলা হচ্ছে লাইসেন্সহীন ছোটো ব্যবসায়ীদের। তেমনি, (৩) H.S. পাস ক্লার্ক বা আট ক্লাসের বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতার পেডিটেটর হল C Class এবং (৪) তারও নিচের শিক্ষাগত যোগ্যতার বা অশিক্ষিত পেডিটেটর , ভ্যান রিকশাচালক, শ্রমিক ইত্যাদি জনতা হল গে' D Class। বোঝা গেল?

জানি এইবার পোশ্নো উঠবে ""TRP Rating কিভাবে করা হয়?"" পড়াশুনোর অভ্যেস তো বাঙালীর আর গেল না। তাইলে কান খাড়া করে শুনতে হবে। মেসিনের গল্পোটাও এখেনেই।
প্রথমে এই ফিল্ড ওয়ার্কাররা বাড়ি টাড়ি ঘুরে র্যাণ্ডাম ডেটা কালেক্ট করে। নাম, ধাম, পড়াশুনো কদ্দুর, কি কি কাজকম্মো করা হয়, আর টিভিতে কোন ভাষার প্রোগ্রাম দ্যাখেন ইঞ্জিরি, হিন্দি না বাংলা। ডেটা অ্যাসেম্বল করে জানা যায় কোন এলাকায় কোন Class এর লোকজন আখড়া বানিয়েছে। এই যেমন সল্টলেক, পার্কস্ট্রীট হইল গিয়া A Class চরণধন্য। নেমে আসুন দমদম মধ্যমগ্রাম , সব B Class মাল। ওদিকে খিদিরপুর গেলেই পাবেন রাশি রাশি D Class

তো, বিভিন্ন রিজিওনাল অফিস থেকে মুম্বাই হেড আপিসে হিসেব নিকেশ গেলে সেখানকার কাকেশ্বর কুচ্কুচে আঁক কষে বলবেন কোন লোকালিটির কোন Class-এর কোন ল্যাঙ্গুয়েজের স্পেসিমেন চাই। ডেটাবেস খুঁজে অমন পাবলিক ঢুঁড়ে দ্বিপাক্ষিক ইন্সটলেশন সম্মতি ও যেকোনোদিন যেকোনোপক্ষের আর্জিতে খুলে ফেলার দাবি মেনে সেই স্পেসিমেনের বাড়ির টিভিতে একটি যন্ত্র বসানো হবে আর পরিবারের সদস্যরা পাবেন লম্বর - ১, ২, ৩ এটসেটেরা। বাপ ESPN দেখবেন তো ১ টিপুন, তাপ্পর চ্যানেলটি। মা ২ টিপে তবে দিন E TV কি Zee বাংলা। ছোঁড়া তো সিনেমা দেখবেই। তা যে চ্যানেলেই যাও বাছা আগে তোমার নম্বর দাবাও। TV-র ওপরে থিতু মেসিন নম্বর পিছু চ্যানেলের ফ্রিকোয়েন্সি গুনে গেঁথে ছাতে রাখা অন্য মেসিনের GSM কার্ডে সেই সব রেডিওওয়েভে পাঠিয়ে রাখবে। প্রতিদিন মুম্বাই আপিসের তালেবর কাকেশ্বরেরা ঐ GSM এ ফোনিয়ে জেনে নেবে ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ। অত:পর চ্যানেলে চ্যানেলে অনুষ্ঠান প্রতি TRP ঢাক বাজাও, লে দনাদ্দন।

এত পড়েও যদি টি আর পি রেটিং না বোঝা যায়, তবে অন্য পাতায় পাল্টি খাওয়াই ভালো। কিন্তু তার আগে জেনে যাওয়া যাক ঘোষিত ভাবে এসব রেটিং-ফেটিং এর হাল হকিগৎ, থিয়োরি প্র্যাকটিকাল এ কূটকচা৯র উদ্দেশ্য নহে। হারগিজ নহে। আমাগো শঙ্কা ভিন্নতর।

ভেবে দেখুন একটি সত্তা দেশটার লোকজনকে চারটে খাপে মুড়ে ফেলেছে। আপনি জানলেনও না হয়তো, কিন্তু আপনি অলরেডি খোপবন্দী। আপনার বাসস্থানের গায়ে ছাপ্পা পড়ে আছে : এ অঞ্চলের লোকজন বেশিটাই A, B, C না D Class-এর। তারা কোন ভাষার অনুষ্ঠান দেখেন, এবং একজন বা দুজনের প্রতিনিধিত্বে, আরো, তারা কোন সময়ে কোন প্রোগ্রাম দেখেন। ""আপনি"" কোন সময়ে কোন প্রোগ্রাম দেখেন। সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে আপনি একটি টিভি চ্যনেলের একটি অনুষ্ঠানের নথিভূক্ত দর্শক হয়ে গেছেন - যেমন কোনো ভোট না দিয়েও বা বিপক্ষে ভোট দিয়েও আপনি শেষ বিচারে এলাকার জয়ী প্রার্থীটির সমর্থক, জয়ী রাজনৈতিক দলটির সমর্থক। আমেরিকার প্রতিটি মানুষ যেমন জর্জ বুশ ও পাকিস্তানের প্রতিটি মানুষ পারভেজ মুশারফের বা ইরাকের প্রতিটি মানুষ সাদ্দাম হুসেনের সমর্থক। বুশ ও সাদ্দামের নীতিগত বিরোধ মানে প্রতিটি আমেরিকাবাসীর সঙ্গে প্রতিটি ইরাকবাসীর বিরোধ, যেমন স্রেফ জাপানে জন্মেছ বলেই তোমার মাথার ওপরে অমোঘ নেমে আসছে পরমাণুবোমা - তুমি তেজস্ক্রিয়ায় দাউ দাউ জ্বলে উঠছ হিরোসিমা। এ নাকি বক্তিস্বাতন্ত্রে
যুগ! অথচ, প্রতিমুহুর্তে আর্থ সামাজিক কাঠামোর এক একটি ক্ষুদ্রতম একক, এক একটি মানুষ, ব্যক্তিগত মুখবিহীন। বৃহত্তর এককটির পরিচয়হীন অংশমাত্র। একটি গড় সংখ্যা। একটি সাধারণ-বৈশিষ্ট্যবাহী টুকরো। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নির্মম শিকার। এবং এতকালের এই রাজনৈতিক পরিসংখান বা পরিসংখ্যানের রাজনীতি এখন পুরোমাত্রায় সাংস্কৃতিক দখলদারিত্বের সামনে নতজানু। মাসে একশটাকা রোজগার করে আপনি যেমন জানতে পারেন সরকারী গণনায় আপনার এলাকার মানুষের গড় আয় মাসে দুহাজার টাকা, অর্থাৎ আপনারও; দুটি নিরক্ষর সন্তানসহ ক্লাস ফোর অনুত্তীর্ণ আপনি যেমন জানতে পারেন আপনার এলাকার মানুষেরা সকলে এইট পাশ, অর্থাৎ আপনারাও; তেমনই হে ফুটপাথবাসী মানুষটি, আপনার কোনো টিভি নেই বললে শুনবো! আমাদের হিসেব মতো সন্ধ্যে সাড়ে ছটা থেকে সাতটা আপনি ই-টিভি তে দেখেন হাইয়েস্ট টি. আর. পি. -র রোজগেরে গিন্নি। সোজা কথা।

এরপর এই আরবিট স্যামপ্লিং-এ প্রমাণ করা কৃত্রিম রুচি, তার প্রচার, তার অনুকরণে গড়ে তোলা ঐ একই প্রোফাইলের প্রোগ্রামপুঞ্জ, টার্গেট ভিউয়ারের প্রতি নিক্ষেপোদ্যত বিজ্ঞাপন বৃষ্টি, অর্থাৎ একটা চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি - আপনাকে, আপনার স্বাতন্ত্র্যকে চুনকাম করে একটা গড় সাংস্কৃতিক রুচির খোলসে মুড়ে ফেলতে থাকছে, যাতে আপনার কোনো হাত আর থাকছে না। সে ঘটনাক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে মুম্বাইয়ের ট্যাম মিডিয়া রিসার্চ প্রাইভেট লিমিটেড। ভারতের টিভি চ্যানেলের TRP Rating দেওয়ার একমাত্র কোম্পানী। মোনোপলি ব্যবসা।

এর পরের বক্তব্যটার জন্যে আর কোনো অক্ষর খরচ নয়। কোনো শব্দ না লিখলেও এর পরের লেখালেখিটা দাড়ি, কমা, লিডার সহ পড়ে ফেলা উচিত।


  ==================================
পাঠপ্রবেশকঃ ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০০৬ তারিখে গুরুচন্ডা৯-র কূটকচা৯ বিভাগে প্রকাশিত। কলামের জন্যে এই লেখা ফরমায়েশি হলেও এটা আমার নিজের ইচ্ছেয় মন থেকে লেখা।

বিষয়টা হঠাৎই পেয়েছিলাম, যখন এই TAM Media Research Pvt. Ltd. আমার বাড়িতে টি-আর-পি রেটিং বুঝিয়ে আমার টিভিতে ওদের যন্ত্র লাগাতে আসে। আমি হেন নগন্য ব্যক্তি TRP Rating কন্ট্রোল করব জেনে উত্তেজিত হয়ে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে ওদের থেকে সমস্ত ইনফো জোগাড় করি।

প্রতিটি মোনোপলি ব্যবসার স্বার্থে গড়ে ওঠা স্বঘোষিত মার্কেট সেগমেন্টালিজম আর সেই অযৌক্তিক সামাজিক-ছাপ্পানির্ভর কনক্লুশনগুলো যেভাবে মিডিয়াকে সাংস্কৃতিক দখলদারিত্বে ডিকটেট করে আমাদের একটা চাপিয়ে দেওয়া রুচীর বোতলে পুড়ে ফেলছে সেটা সমর্থন করতে পারিনি। এই লেখাটুকুই আমার প্রতিবাদ।

No comments: