মা
ভারতবর্ষকে বিদেশের লোকেরা
গরীব বললে খারাপ লাগে কেন? ভারতবাসীরা খেতে পায়না বললে ব্রহ্মতালুতে আগুন জ্বলে যায়
কেন? এটা তো সত্যি কথা। সত্যি তো আমার দেশ গরীব। যার মা গরীব, তাকে যদি কেউ বলে,
"হ্যাঁ রে, তোর মা খুব গরীব না? " সে কি রেগে যাবে? সে মাথা নিচু করে বলবে
না - "হ্যাঁরে, খুব গরীব। তাইতো এবার, দ্যাখ না, প্রদীপদা কে বলে আরো দুটো টিউশনি
যোগাড় করেছি। পূজোর সময় যখন বাড়ি যাবো, মার জন্য একটা ভালো শাড়ি কিনে নিয়ে যাব।
আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে
পড়ত। একবার সেলের উৎসবে আমরা সবাই টিউশন ফিরতি পথে খুব ফূর্তিতে জামা কাপড় কেনা-কাটি
করছি, আর ছেলেটা আমদের সথে থাকলেও কিচ্ছু কিনলো না। আমাদের সবার যখন দু-তিনটে করে জিনিস
কেনা হয়ে গেছে, আর ও একটাও কেনেনি, আমরা সব্বাই খুব চেপে ধরলাম ওকে, " কেন্ না
একটা। কত সস্তা! দেড়শো-দুশো টাকায় এমন জামাকাপড় পাওয়া যায় নাকি? কেন্ না! পয়সা নেই?
বল্, আমি দিয়ে দিচ্ছি। হস্টেলে ফিরে দিয়ে দিস। না হয় পরের মাসে দিস।"
খুব জোরাজুরির মাঝে হটাৎ
ঠাণ্ডা গলায় ছেলেটা বলেছিল, "আমার বাবা গ্রামে একটা চায়ের দোকান চালায়। দিনের
শেষে দেড়শো টাকা রোজগার হয় না, আর আমি একটা টি-শার্ট কিনে দেড়শো টাকা উড়িয়ে দেব? না
ভাই, পারব না। তোরা কেন্।" আমরা স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম।
হিন্দুস্তান লিভারে চাকরির
ইন্টারভিউতে ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করা হল, "এই চাকরিটা তুমি কেন করতে চাও?"
ও বলেছিল, "আমাদের গ্রামে ভালো স্কুল নেই। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া
শেখার অগেই শিশুশ্রমিক হয়ে যায় বা সমাজবিরোধীদের হাতে গিয়ে পড়ে। যদি কোনোদিন পারি,
গ্রামে একটা ভালো স্কুল করে দেব। আমাদের গ্রামের প্রায় সব্বাই খুব গরীব, ৪-৫ টা ছাড়া
পাকা বাড়ি নেই। মাটির রাস্তা। বর্ষাকালে আমাদের খুব কষ্ট হয়। যদি কোনোদিন পারি, সবার
মাথায় পাকা ছাদ গড়ে দেবো। আমাদের গ্রামেও পাকা রাস্তা থাকবে। আর কোনো একদিন এইসব করার
জন্য আজ আমার এই চাকরিটা চাই।"
আজও দেখা হলে, কথা হলে
ছেলেটা বলে, "যাব, একদিন ঠিক ফিরে যাব, দেখিস। ততদিন লড়ে যাচ্ছি।"
আমি প্রার্থনা করি, ও পারুক।
হাতে করে আলো নিয়ে যাক। খুশির প্রদীপ জ্বালাক অনেক অনেক চোখে। সে সব চোখ - তারা তো
অপেক্ষায় আছে। আমি জানি, তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে আকাশের দিকে হাত জোড় করার সময়,
ওর মার দুচোখে দুফোঁটা জল আসে। প্রতিদিন।
আমরা তো সবাই লড়ে যাচ্ছি।
ঘরে বাইরে, মাঠে-প্রান্তরে দেশে-দেশান্তরে। দম বন্ধ করে চোরাগোপ্তা মার দিয়ে-খেয়ে এখনো
হার মানিনি। কোমরে গুঁজে চলেছি কৃপণ হাতে সঞ্চয়। আমাদের মা যে জ্যালজ্যালে ছেঁড়া শাড়ি
পরে মাটির দাওয়ায় বসে পান্তাভাত খায়। কোনো দু:খ নেই, মুখে সেই হাসি। যতবার টাকা দিই
হাতে, আলাদা করে রাখে - "তোর ভাইয়ের স্কুলে লাগবে।" "বোনের বিয়ে দিতে
হবে না!"
- "মা তোর জন্য কিছু
রাখবি না?"
- "না রে বোকা, আমার
কি লাগবে তোরা তো আছিস। আমার এতগুলো ছেলে! কবে তোরা সবাই আসবি বাবা? এই দাওয়ায় বসে
সবাই একসঙ্গে খাবি। আমি ভাত বেড়ে দেবো?"
আসবো মা, আসবো। যত দেশে
দেশে ছড়িয়ে রয়েছি আমরা সব সব ভাইয়েরা বোনেরা একদিন একসাথে ফিরে আসবো। মুঠোয় করে নিয়ে
আসবো তোর সমস্ত বন্ধক রাখা গয়নাগুলো। নতজানু হয়ে তোর সামনে বসে যখন সবাই আমরা তোর সন্তানেরা
আ-কন্যাকুমারী একসাথে মুঠো খুলে ধরব, সূর্যও
চমকে যাবে তোর ঐশ্বর্যের ঝলকানি তে। তোকে পরিয়ে দেব সোনার সুতোয় বোনা বেনারসী। তোকে
ঠিক রাজেন্দ্রাণীর মতো লাগবে - যেমন বিয়ের পর প্রথম গৃহপ্রবেশে তুই এসেছিলি। এই মাটির
কুটিরের পাশে তোর সাতমহলা রাজপ্রাসাদ বানিয়ে দেবো মা। দেখিস একদিন আমরা, আমরা সবাই
ফিরে আসবো। এইতো আর কটা মাত্র দিন।
একটু সবুর কর।
(আর পারছি না, চোখ জ্বালা
করছে, আজ আসি)
No comments:
Post a Comment